কেলাশ, ভুতমুড়ি, পুঙ্গার ... চট করে নাম গুলো শুনে বোঝা শক্ত! এরা সব একেক রকমের ধান। তাদের গুণও একেক রকম। যেমন আমাদের জয়নগরের মোয়া তৈরী হত কনকচুড় ধানের খই দিয়ে। এখন বেশিরভাগ কারিগরেরা মোয়াতে কৃত্রিম গন্ধ দিয়ে দেন। বর্তমানে কনকচুড় ধানের চাষ প্রায় উঠে গেছে বললেই হয়।
এমনি কত কত প্রজাতির ধান ছিলো ভারতে। মার্কিন বহুজাতিক মনস্যান্টো আর কার্গিলের হাত ধরে ভারতে হাইব্রিড ধান আসার আগে, চাষিরা নিজেরাই এসব দেশজ ধানের প্রজাতি তৈরী করেছিলেন। ভারত কৃষি প্রধান দেশ, হাজার হাজার বছর ধরে তাই কৃষকরা এই ধানগুলির চাষ করে গেছেন।
১৯৬০ – ১৯৭০ এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১ লক্ষ ধানের প্রজাতি পাওয়া যেত। কিন্তু আস্তে আস্তে এই প্রজাতিগুলি বিপন্ন হতে শুরু করে। কিছু কিছু ধানের প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন জিনগত রোগের প্রভাব ছিলো। সেই সময় প্রযুক্তি উন্নত ছিল না। তাই জিনগত রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে ধানের প্রজাতিগুলিকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে মূলত বেশি উৎপাদনের আশায় কৃষকরা ধীরে ধীরে দেশজ ধানের প্রজাতির চাষ ছেড়ে হাইব্রিড ধানের চাষ করতে শুরু করেন। তার সঙ্গে শুরু হয় প্রচুর রাসায়নিক সারের ব্যবহার ও ভুগর্ভস্থ জলের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ। ধীরে ধীরে জমি বন্ধ্যা দেখা দেয়। ভুগর্ভস্থ জলস্তরও নামতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে এক শ্রেণীর বৈজ্ঞানিক এবং কৃষক হাইব্রিড ধানের পরিবর্তে দেশজ ধানের ব্যবহার করতে শুরু করেন। এই সময়েই বেশ কয়েকটি ধান বীজ ব্যাঙ্ক তৈরী হয়। ব্রীহি তেমনই একটি উদ্যোগ। ১৯৯৭ সালে “ব্রীহি” তার কাজ শুরু করে।
বিপন্ন দেশজ ধানের প্রজাতির সংরক্ষণ করতেই এই ধান বীজব্যাঙ্কটির প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রীহির প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক দেবল দেব। ব্রীহি বর্তমানে পূর্ব ভারতের মধ্যে বৃহত্তম ধান বীজ ব্যাঙ্ক।
১৯৯৭ সালে দেশজুড়ে শস্য সংরক্ষণ আন্দোলন চলছিল। তার পটভূমি থেকেই ডঃ বন্দনা শিবার ভূমিকা ব্রীহির কাজকে অনুপ্রাণিত করে। ২০০০ সাল থেকেই ব্রীহি প্রতিষ্ঠাতা দেবল দেবের ব্যাক্তিগত অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়েই বীজ সংরক্ষণের কাজ করতে থাকে। এক্ষেত্রে তার রোমান বন্ধু ডঃ পাওলোরোবারতো ইম্পেরেলির ভূমিকাও অনস্বীকার্য। তাঁর আর্থিক সহযোগিতায় বসুধা নামের একটি গবেষণা কেন্দ্রও তৈরি করা হয়। ২০০১ সাল থেকে এই গবেষণা কেন্দ্রটিতে দেশজ ধান প্রজাতি সংক্রান্ত গবেষণাও শুরু হয়।
ব্রীহি বেশ বহুদিন ধরেই বাংলার হারিয়ে যাওয়া ধানের প্রজাতি নিয়ে কাজ করছে। মূলত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই প্রজাতিগুলির দেখা মেলে। দেশজ ধানের প্রজাতিগুলি বর্তমান নতুন ধান প্রজাতিগুলির থেকে অধিকতর উন্নত। যেমন বর্তমান নতুন ধানের প্রজাতিগুলির মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা, খরা নিয়ন্ত্রন ক্ষমতা, লবণ সহায়ক ক্ষমতা এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ধানের সুগন্ধ-এর মত চারিত্রিক বৈশিষ্টগুলির দেখা মেলাই ভার। ক্রমাগত এই ধানের প্রজাতিগুলির চাষের ফলে পরিবেশের ওপরেও একটি প্রভাব পড়ছে। তবে দেশজ ধানের প্রজাতিগুলির মধ্যে কীটপতঙ্গ সহনশীলতা ছাড়াও বিভিন্ন দুর্যোগের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতাও রয়েছে। দেশজ ধানের প্রজাতির সংরক্ষণ উদ্ভিদ বৈচিত্র নিয়ন্ত্রণেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন বহু দেশজ ধান রয়েছে যেগুলির সঙ্গে সরাসরিভাবে বাংলার লোকউৎসব বা পার্বণের সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জামাই - শাল চালের কথা। এখনও জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাই ষষ্ঠীতে এই চাল ব্যাবহার করা হয়।
দেশজ চালের মধ্যে রঙের হেরফেরও বেশ আকর্ষণীয়। এই যেমন লাল রঙের চালের প্রজাতির মধ্যে - পুঙ্গার, পিসিনি, মাপ্পিলাই,কাত্তুয়ানাম, নাভারা ইত্যাদি লোকজ ধানের প্রজাতির খোঁজ মেলে। আবার কালো রঙের চালের মধ্যে - কাভুনি, চাখাও, বার্মা এগুলো অন্যতম। দেশজ চালের সুগন্ধও কিন্তু এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট। সুগন্ধী দেশজ চালের মধ্যে গীতাঞ্জলী, কেটেকিজোহা, পূর্ণাভোগ অন্যতম। বন্যা সহনশীল দেশজ চালের প্রজাতির মধ্যে হেতমমারি, জলঢেপা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া খরা সহনশীল দেশজ চালের প্রজাতির মধ্যে ভুতমুড়ি, কেলাশ, কাকড়ি বেশ প্রসিদ্ধ।
কেলাশ এবং ভুতমুড়ি যে কেবল খরা সহনশীল ধানের বীজ তা কিন্তু নয়। এই ধানের প্রজাতিগুলির মধ্যে আয়রন এবং জিঙ্কও রয়েছে ভরপুর। মূলত এই প্রকারের চালগুলি নিজের ডায়েটে রাখলে রক্তাল্পতা কম হয়। পারমাইশাল চাল দেহের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মূলত শিশুদের দুধের সঙ্গে এই চাল দেওয়া হয় পুষ্টির জন্যে। অনেক সময় সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেও স্তন্যদাত্রী মায়েদেরও এই চাল খাওয়ানো হয়। গরীবশাল চাল আবার হজম করতে সহায়ক। শুধু এগুলোই নয় এমন অনেক চাল রয়েছে যেগুলোর থেকে ঔষধি এবং পুষ্টিগুণ দুই পাওয়া যায়। গ্রাম বাংলার মানুষেরা তাই এখনও এই ধরণের চালের প্রজাতিগুলিকে নিজেদের খাদ্যাভ্যাসে রেখেছেন।
ব্রীহি যে কেবলমাত্র দেশজ ধানের বীজ সংরক্ষণ করে তাই নয়, বরং ব্রীহির একটা বড় কাজ হল কৃষকদের মধ্যে এই ধানের প্রজাতিগুলি পৌঁছে দেওয়া। এক্ষেত্রে যে কৃষকরা দেশজ ধানের প্রজাতি চাষ করতে চান তাদের ব্রীহি বীজব্যাঙ্কে এসে বীজ নিয়ে যেতে হবে। বিনামূল্যেই ওড়িশার কেরানডিগুড়া গ্রাম থেকে তারা বীজ সংগ্রহ করতে পারেন। প্রতি বছরের মার্চ থেকে জুন মাস পর্যন্ত এই বীজ দেওয়া হয়। এই চার মাসে যেকোনও সময় কৃষকরা এসে বীজ সংগ্রহ করতে পারেন। ব্রীহির আধিকারিকরা কৃষকদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকেন। যেমন কৃষকরা কোন জমিতে চাষ করবেন, সেই জমির মাটির প্রকৃতি কেমন এই বিষয়গুলির ওপর নির্ভর করেই তারা কৃষকদের উপযুক্ত ধানের বীজ বেছে নিতে সাহায্য করেন। তবে এই চারমাসের মধ্যে যদি কোনও কারণে কৃষকরা দেখেন যে বীজ সংগ্রহ কেন্দ্র বন্ধ, সেক্ষেত্রে একটি চিরকুটে তারা তাদের নাম, এবং তাদের জমির প্রকৃতি যেমন – উচ্চভূমি নাকি নিম্নভূমি বা জলাজমি নাকি শুকনো জমি, মাটির প্রকৃতি, এবং আবাহাওয়ার প্রকৃতি কেমন এগুলো লিখে জমা দিয়ে আসতে পারেন, পরে ব্রীহির আধিকারিকরাই সেই সমস্ত কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন।
ব্রীহি কৃষকদের বীজ সরবরাহ করার পাশাপাশি, তাদের মধ্যে বীজ আদানপ্রদানেও বিশেষভাবে নজর দেয়। সবুজ বিপ্লবের ফলে দেশের কৃষিতে যে আমূল পরিবর্তন এসেছিল সেই বিষয়টাকে সামনে রেখেই ব্রীহি বীজ বিনিময়ে গুরুত্ব দিয়েছে। এখানেই বিষয়টা স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন। আমরা ইতিহাসে পড়েছি, প্রাচীনযুগে বিনিময় প্রথার প্রচলন ছিল আমাদের দেশসহ গোটা পৃথিবীতেই। সেখানে অর্থ বিনিময় না হয়ে জিনিস বিনিময় হত। ব্রীহির ক্ষেত্রেও পদ্ধতিটা ঠিক একই রকম, তবে এখানে দুজন কৃষকের মধ্যে ধান বিনিময় হয়। আর তাদের মাঝে মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ব্রীহি। দুজন কৃষকই তাঁদের নিজের জমিতে ফলানো ধান ব্রিহীতে এসে জমা করেন। অন্তত ১ কেজি করে দেশজ ধান প্রত্যেক কৃষককেই দিতে হবে। এরপর ব্রীহি কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সেই ধান সরবরাহ করে।
ব্রীহির সমস্ত দেশজ উন্নত মানের ধানের প্রজাতিগুলি চাষ হয় বসুধা গবেষণা কেন্দ্রে। প্রত্যেক বছর ব্রীহি থেকে সমস্ত দেশজ ধানের প্রজাতি এনে ছোট পরিসরে নমুনা হিসেবে চাষ হয়। এই নমুনাগুলি পরের বছরের জন্যে সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়া হয়।
এই সংস্থা বর্তমানে কাজ করছে ওড়িশার রায়গড়া জেলা থেকে। ব্রীহির আধিকারিকদের মিলিত প্রচেস্টায় এটি পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, বিহার, ওড়িশা, মেঘালয়, কর্নাটক, মহারাস্ট্র, গুজরাট, কেরালা, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব এবং উত্তরাখন্ডের বিভিন্ন জেলা থেকে দেশজ ধানের বীজ সংগ্রহের কাজ করছে।
দীর্ঘ ২০ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রসারিত হয়েছে এই সংস্থা। ১৯৯৮ সালে মাত্র ২১ জন কৃষক এই সংস্থায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ব্রীহির সঙ্গে অগণিত কৃষক নিজেদের যুক্ত করেছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ সালের প্রথম দিকে চারটি রাজ্যকে মিলিয়ে ১৬৮০ জন কৃষক যুক্ত ছিলেন এই সংস্থার সঙ্গে। তবে এপ্রিল ২০১৯ পর্যন্ত ১০ টি রাজ্য মিলিয়ে কৃষকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬০০ এর বেশি। উল্লেখযোগ্যভাবে ৯১০টিরও বেশি দেশজ ধানের প্রজাতি ব্রীহিতে বিনিময় করা হয়। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হল, এই সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কৃষকরা তাঁদের আর্থিকদিক চিন্তা না করেই বিপন্ন ধানের প্রজাতির চাষে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এরফলে এই সমস্ত বিপন্ন প্রজাতির ধানের চারাগুলির অস্ত্বিত্ব সংকট তুলনায় কমছে দিনদিন।
ব্রীহির ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান আরও চমকপ্রদ। এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত, ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, কোরিয়া, ফিলিপিন, জাপান, ইতালি, আমেরিকা ইত্যাদি দেশের প্রায় ১৪৮০ টি ধান জমির বীজ সংগ্রহ করেছে ব্রীহি। এর পাশাপাশি কৃষকদের জন্যে একাধারে সচেতনতামূলক প্রচারও চালাচ্ছে ব্রীহি নিয়মিত। এরফলে কৃষকদের মধ্যে দেশজ ধানের বীজ সংরক্ষণ করার বিষয়ে আরও বেশি সচেতনতা তৈরি হবে। ব্রীহির এই চিন্তাভাবনা সুস্থায়ী ফার্ম গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ব্রীহি কৃষকদের স্বার্থে অত্যন্ত সযত্নে প্রায় দুদশকের বেশি সময় ধরে কাজ করছে। শুধু দেশে নয় বর্তমানে দেশের বাইরেও ব্রীহির কাজ ছড়িয়ে পড়েছে। নতুনত্বের সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে কৃষক স্বার্থ রক্ষায় ব্রীহির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
ভাবার মত প্রশ্ন -
Reference -