প্লাস্টিকের বোতলে বাগানবাহার

Saheli Mazumdar
November 20, 2024

“প্লাস্টিক” শব্দটা শুনলে প্রথমেই  মাথায় আসে দূষণের কথা। প্লাস্টিকের ফলে জল, মাটি, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে জলজ প্রাণীদের জীবন। 

প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করেই বাগান সাজাচ্ছেন পাপন মোহান্ত। ১৫০০ প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার করে ফুলচাষ করছেন তিনি।  পাপন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনী মহকুমার পিরাকাটা রেঞ্জের বনদপ্তরের আধিকারিক।

 প্লাস্টিক আমাদের পরিবেশের জন্যে অত্যন্ত ক্ষতিকারক। ভারতবর্ষে প্রতিদিন প্রায় ২৬ হাজার টন প্লাস্টিক ব্যবহার হয়। এর মধ্যে ৪০% প্লাস্টিক সংগ্রহ হয়না। মাত্র ৮% পুনর্ব্যবহার করা হয়।  ২০২১ সাল থেকে ভারতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বেড়েছে ৭.১১%। রিপোর্ট অনুযায়ী, তেলেঙ্গানায় সবথেকে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়। যার পরিমাণ বার্ষিক ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার মেট্রিকটন। পরিবেশের গুণমান স্বাভাবিক রাখতে প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারই একমাত্র উপায়। 

পশ্চিমবঙ্গের বুকে  একটি ছোট্ট এলাকা শালবনী। সেখানেই বনদপ্তরের আধিকারিক পদে নিযুক্ত পাপন মোহান্ত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোটা পৃথিবী প্লাস্টিকের মোড়কে মুড়িয়ে যাচ্ছে। এই চিন্তাভাবনা থেকেই নিজের এলাকার বিভিন্ন প্লাস্টিকের বোতল ও টায়ার সংগ্রহ করতে শুরু করেন পাপন। পরিকল্পনা করেন একটি বাগান বানানোর। 

বাড়ির আশপাশ থেকে প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করে তার মধ্যেই শুরু করেন বাহারি ফুলের চাষ।  মূলত শীতের সময়ে রঙ বেরঙের পিটুনিয়া ফুলের চাষ প্লাস্টিকের বোতলে ভালো হয়। এছাড়াও সাদাবাহার ফুল নিজের বাগানে এই প্লাস্টিকের টবেই চাষ করেন পাপন। 

বেশ কয়েক বছর ধরে এইভাবেই নিজের বাগান সাজাচ্ছেন পাপন। শালবনী এলাকার বিভন্ন স্কুলে গিয়েও তিনি সচেতনতামূলক প্রচার করেছেন। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তার এই প্রচেষ্টাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন স্কুলগুলির শিক্ষক - শিক্ষিকা থেকে শুরু করে ছাত্র ছাত্রীরা। 

এলাকার মানুষও এগিয়ে এসেছেন তাঁকে সাহায্য করতে। বাড়ির প্লাস্টিকের বোতল বা টায়ার পাপনকে দিয়ে অপেক্ষা করতেন তাঁরা। এইগুলি দিয়েই প্রতিবার নানা রঙের  নতুন ফুলের টব বানিয়ে চমক লাগিয়ে দিতেন পাপন। এইভাবেই প্রায় ১৫০০ প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে নিজের কোয়ার্টারের বাগান সাজিয়ে তুলেছেন। তাঁর ছোট্ট  ছেলেও এই কাজে তাঁকে সাহায্য করে। 

প্লাস্টিক আলগাভাবে পড়ে থাকলে মাটির সঙ্গে মিশতে প্রায় ৫০০ বছরের কাছাকাছি সময় লাগে। ফলে মাটি দূষণের সম্ভাবনা চূড়ান্ত। মাটি দূষণ এড়াতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ কমাতে হবে। ভারতের সিকিম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরায় সবথেকে কম প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়।  

প্লাস্টিক ব্যবহার করেই দেশের নানা প্রান্তে বানানো হচ্ছে বাগান। কর্ণাটকের সিরসি কলেজ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ৭০০ প্লাস্টিক বোতলের ব্যবহারে সবজি বাগান করেছে ছাত্রীরা। ব্যবহার হয়েছে পুরনো টায়ার,তেলের কৌটো, রঙের বাক্স।  বাগানে উৎপাদিত সবজি দিয়েই হোস্টেলের  ২৫০ জনের খাবার বানানো হয়। প্রায় ২৫ রকমের সবজি এই বাগানে চাষ হয়। মূলো, গাজর, টম্যাটো,ঝিঙে, ক্যাপসিকাম, করলা, কড়াইশুঁটি,বেগুন, পালং শাক - এই সবজিগুলি প্লাস্টিকের বোতলে চাষ করা সম্ভব। পাতা জাতীয় সবজি (ধনেপাতা, পালং শাক) চাষের ক্ষেত্রে বোতলগুলির মাঝ বরাবর কাটা প্রয়োজন। 

মূল জাতীয় সবজির(পেয়াজ,রসুন,মূলো) ফলনের ক্ষেত্রে লম্বাভাবে বোতলগুলি কাটা প্রয়োজন।  

মাটি ছাড়াই সবজি উৎপাদন সম্ভব প্লাস্টিকের বোতলে। মাটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় নারকেলের ছোবড়া, ভার্মিকম্পোস্ট, নিম কেক। সামান্য জলও ব্যবহার হয় আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে। 

কর্ণাটকের সিরসি কলেজের অধ্যাপক শিবানন্দ হোঙ্গাল, ইজরায়েল থেকে এই পদ্ধতি শিখে আসেন। পরবর্তীতে নিজের কলেজের উদ্যানবিভাগের ছাত্রীদের সহযোগিতায় সবজি বাগান তৈরি করেন। 

পাঞ্জাবে রোহিত মেহেরা ৭০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে বাগান বানিয়েছেন। তিনি আয়কর দপ্তরের আই আর এস অফিসার। পাঞ্জাবের দূষণ কমানো এবং প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। রোহিত  স্কুল, কলেজ, পুলিশ স্টেশন, রেলওয়ে স্টেশন, সরকারি অফিস, গুরুদ্বার ইত্যাদি এলাকায় বাগান তৈরি করেছেন। এএনআই সূত্রে রোহিত মেহেরা জানিয়েছেন, পাঞ্জাবের বাতাসের গুণগত মান অত্যন্ত খারাপ। সেই কারণে মাঝে মধ্যেই বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। একজন অভিভাবক হিসেবে তিনি মনে করেন এটি কাম্য নয়। প্রত্যেকটি শিশুর সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে। 

এই ধরণের বাগান তৈরিতে খরচ অনেক কম। খুব অল্প জায়গাতে বানানো যায়। ড্রিপ সেচের ফলে ৯২% জল সঞ্চয় সম্ভব। পাঞ্জাব এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির একজন গবেষক এই বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, যে সমস্ত এলাকায় এই ধরণের বাগান রয়েছে সেখানে দূষণের পরিমাণ কমছে। 

 ভারতে প্রতি বছর  ১০% হারে  বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। ২০% হারে বাড়ছে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ। বিশ্বজুড়ে, প্রতি মিনিটে এক মিলিয়ন প্লাস্টিকের বোতল কেনা হয়। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে পাঁচ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিক সহ প্লাস্টিক এখন সর্বত্র। 1950 থেকে 1970 এর দশক পর্যন্ত, শুধুমাত্র অল্প পরিমাণে প্লাস্টিক উৎপাদিত হত। ফলস্বরূপ, প্লাস্টিক বর্জ্য তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল।1970 এবং 1990 এর দশকে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। 2000 সাল শুরুর দিকে প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎপাদন গত  40 বছরের তুলনায় অনেকটা বেড়ে যায়। 2050 সালের মধ্যে প্লাস্টিকের উৎপাদন 1,100 মিলিয়ন টনে পৌঁছতে পারে। 

অতি সত্বর প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা উচিত বলে বিবৃতি জারি করেছেন  বিজ্ঞানীরা। সেক্ষেত্রে অভিনব পদ্ধতিতে প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। 

ভাবার মতো প্রশ্ন - 

  • পশ্চিম  মেদিনীপুর জেলায় শিল্পায়নের কারণে প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। সেক্ষেত্রে বছরে কতো টন প্লাস্টিক ব্যবহার হয় এই জেলা থেকে? ব্যবহারের পর সেই প্লাস্টিক কি হচ্ছে? কীভাবে কম খরচে সাধারণ মানুষ প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করতে পারেন? 
  • প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করে বিভিন্ন আসবাবপত্র বানানো সম্ভব। এই আসবাব কতটা টেকসই? এর থেকে দূষণ ছড়ানোর কোনও সম্ভাবনা থাকে কি? 
  • প্লাস্টিকের বোতলে সবজি চাষ সম্ভব। কেন এই পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে বড় পরিসরে কাজ হচ্ছে না? ব্যবসায়িক দিক থেকে কোনও অসুবিধা হতে পারে কি? 
  • মাশরুম চাষ করা কি সম্ভব প্লাস্টিকের বোতলে? 

Reference - 

Plastic Bottles to Discarded Tyres: Forest Officer Upcycles Waste Into Stunning Garden! 

Bengal Forest Officer Creates A Garden Recycling Plastic Bottles, Rubber Tyres | News

Karnataka College Upcycles 700 Plastic Bottles Into Stunning Hanging Garden! 

Sirsi college students build bottle garden, score green points.

Punjab-based IRS officer creates vertical gardens with waste plastic bottles | YourStory 

Visual Feature | Beat Plastic Pollution

আরো উদ্যোগের খবর

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram