৬০০ মহিলা আর অংশুল গুপ্ত ফিরিয়ে এনেছেন গারা, পেতিত পয়েন্ট

Saheli Mazumdar
November 11, 2024

নকশি কাঁথা, চিকনকারি, জারদৌসি, এই নামগুলো আমাদের চেনা। তবে গারা আর পেতিত পয়েন্ট  এমব্রয়ডারির কথা কম লোকেই জানে।

গারা একধরণের পারসি এমব্রয়ডারি। পেতিত পয়েন্ট হল ফরাসি । ভারতে গারা এবং পেতিত পয়েন্টের প্রচলন হয় ১৮ থেকে ১৯ শতকের শুরুর দিকে। কিছুদিনের মধ্যে সেলাই দুটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হঠাৎ বিংশ শতাব্দীর পর থেকে এমব্রয়ডারিগুলি হারিয়ে যেতে শুরু করে।

গত দুদশক ধরে অংশুল গুপ্ত পশ্চিমবঙ্গে গারা এবং পেতিত পয়েন্টকে ফিরিয়ে এনেছেন। প্রায় ৬০০ মহিলা তাঁর সংগঠন - “প্রস্তুতি ডিজাইন্সে” কাজ করছেন।  

“সারা গায়ে তাঁর জড়ায়ে রয়েছে সেই নকশি কাঁথা , আজও গাঁ - র লোকে বাঁশি বাজাইয়া গায় এ করুণ গাঁথা” - গ্রামবাংলার সঙ্গে নকশি কাঁথার সম্পর্ক চির নিবিড়। ষোড়শ শতকে বাংলায় নকশি কাঁথার প্রচলন হয়। একবিংশ শতাব্দীতেও প্রায় তিরিশ হাজার কারিগর নকশি কাঁথা তৈরি করেন।

ভারতের সেলাই এর ইতিহাসে গারা এবং পেতিত পয়েন্ট এমব্রয়ডারিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “গারা” বা “পারসি গারা” ভারতীয় পারসি সম্প্রদায়ের হাতে তৈরি ঐতিহ্যবাহী একটি এমব্রয়ডারি।  পারসি গারার উদ্ভবের পিছনে একটা ইতিহাস রয়েছে। ১৯ শতকে পারসি ব্যবসায়ী এবং কারিগররা পারস্য অর্থাৎ বর্তমান ইরান থেকে ভারতে আসেন। বসবাস শুরু করেন গুজরাটে। চীন থেকে চা কিনে এনে ভারতে ব্যবসা করার পরিকল্পনাই ছিল তাদের। চীনে ব্যবসায়িক ভ্রমণের সময়েই তারা “গাজ”/ “পাজ” নামের একধরণের সিল্কের কাপড় দেখতে পান। এই কাপড়গুলোর উজ্জ্বলতা এবং সৌন্দর্য্য ছিল অসামান্য। ব্যবসায়ীরা এই কাপড় তাঁদের স্ত্রী- এর জন্যে কিনে আনেন ভারতে। এভাবেই চীনের সঙ্গে ব্যবসা চলাকালীনই এই এমব্রয়ডারিটি ভারতে আসে। আস্তে আস্তে এটি মুম্বাই এবং সুরাটে বিখ্যাত হয়ে যায়।

পারসি গারা এমব্রয়ডারির পটু শিল্পীরা বলেন, কোনও নকশা কাপড়ে তোলার আগে তারা কাগজে এঁকে নেন। তার ওপর চাপান রঙ। এই এমব্রয়ডারিতে ফুল, পাখি, প্রজাপতি এবং প্রকৃতির ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। ক্যানভাসের পর নকশাগুলি মূলত শাড়ি, ব্লাউজ এবং জামায় তৈরি করেন শিল্পীরা। এক একটা কাজ শেষ করতে প্রায় দুই থেকে আট মাসের মতো সময় লাগে।  খুব সূক্ষ্ম একটি সূঁচ ব্যবহার করা হয় এই নকশাগুলি সেলাই করতে। সব থেকে মজার বিষয় হল, এক একজন শিল্পী এক একরকম মোটিফে পারদর্শী। তারা তাঁদের পারদর্শিতা অনুযায়ী নকশা ফুটিয়ে তোলেন । 

বিয়েতে উত্তর ভারতীয়রা বেনারসি শাড়ি পড়েন। ঠিক তেমনি দক্ষিন ভারতীয়রা পড়েন কাঞ্চিপুরাম শাড়ি। মহারাষ্ট্রের বিয়ের কনেরা আবার পড়েন পাইঠানি শাড়ি। গারা এমব্রয়ডারি শাড়িও পারসি বিয়েতে ঠিক এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ।

পেতিত পয়েন্ট ফ্রান্সের অত্যন্ত পুরনো একটি সেলাই। মধ্যযুগ থেকেই এই সেলাই প্রচলিত। প্রথমে ধর্মীয় কাজের জন্যেই এই এমব্রয়ডারি করা জিনিস ব্যবহার করা হত। ফরাসি বিপ্লবের পরে বাড়ির বিভিন্ন জিনিস বানাতেও এই এমব্রয়ডারির ব্যবহার শুরু হয়। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে পেতিত পয়েন্ট এমব্রয়ডারি ক্রমশ বিখ্যাত হতে শুরু করে। ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই এর স্ত্রী ম্যাডামে ডে পম্পাডর এবং স্কটল্যান্ডের রাণী ম্যারি পেতিত পয়েন্ট এমব্রয়ডারি করতেন।

অষ্টাদশ উনবিংশ শতকে ইউরোপিয়ানদের হাত ধরে ভারতে পেতিত পয়েন্ট আসে। এক বর্গইঞ্চিতে প্রায় ৩২৪ থেকে ৫৭৬টি সেলাই করা হয়। বিভিন্ন রঙের সুতো দিয়েই হয় এই সেলাই । রঙিন সুতো ব্যবহারের জন্যেই এটি দেখতে আকর্ষণীয় লাগে। পেতিত পয়েন্ট এমব্রয়ডারির একটি শাড়ি বানাতে ১৫০০ থেকে ৫০০০ ঘন্টা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে ১০- ১২ জন একসঙ্গে কাজ করেন।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ফ্যাশানের দুনিয়ায় কিছু পরিবর্তন আসে। ব্যবহার কমতে শুরু করে গারা এবং পেতিত পয়েন্টের। এমব্রয়ডারিগুলি খুব কম শিল্পীই করতে জানতেন। তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম এই সেলাই শিখতে চায়নি অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ বলেই। ২০০০ সাল নাগাদ অংশুল গুপ্ত গারা এবং পেতিত পয়েন্টকে ফিরিয়ে আনেন।

১৯৯০ এর দশকে দীপা গুপ্তের হাত ধরে প্রস্তুতি ডিজাইন্সের যাত্রাপথ শুরু। সেই সময়ে অনেক জন মহিলা তার সঙ্গে কাজ করতেন।  তখন প্রস্তুতি ডিজাইন্সে কেবলমাত্র কাঁথা স্টিচের জিনিসই পাওয়া যেত। পরবর্তী সময় দীপা গুপ্তের দুই সন্তান তাঁর এই ব্যবসাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। তাঁরা কাঁথা স্টিচ নয়, পারসি গারা এবং পেতিত পয়েন্ট দিয়ে ডিজাইন্স করবেন বলে স্থির করেন। তার জন্যে দরকার দক্ষ শ্রমিক। এই সময়েই উত্তরপ্রদেশে দুজন শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় অংশুল গুপ্তের। ঘটনাচক্রে তাঁরা চাইছিলেন তাঁদের বাড়ি অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে। তখনই অংশুল ঠিক করেন তাঁদের দিয়েই গ্রামের মহিলাদের প্রশিক্ষণ করাবেন।  

প্রস্তুতি ডিজাইন্সের শিল্পীরা কেবল কাঁথা স্টিচ জানতেন। নতুন এমব্রয়ডারি শেখা তাঁদের জন্যে কষ্টকর। গারা এবং পেতিত পয়েন্ট অত্যন্ত নিপুণ সেলাই। এগুলির জন্যে প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং সময়ের। শিল্পীদের অনেকেই এই সেলাই শিখবেন না বলেছিলেন। কিন্তু অংশুল জানান এই দুটি সেলাই শিখলে তাঁদের কাজের আর কোনও অভাব হবে না। এই কথায় বিশ্বাস করেই তারা সেলাইটি শিখতে শুরু করেন। ৬ মাস  প্রশিক্ষণও হয় তাঁদের। প্রশিক্ষণ চলাকালীন প্রত্যেক মহিলাকে মাসে ৫০০ টাকা দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষে উত্তীর্ণ মহিলাদের রোজ ৩৫০ টাকার কাজে নিযুক্ত করা হয়। মোট ৬০০ মহিলা এখন প্রস্তুতি ডিজাইন্সে কাজ করছেন। এই সংস্থায় কাজ করেই তারা স্বনির্ভর। রঙিন সুতোয় স্বপ্ন বুনে এগিয়ে চলছেন নতুন দিগন্তে।     

ভাবার মত প্রশ্ন  

  • পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীরাই এই দুটি বিদেশী এমব্রয়ডারি নিয়ে কাজ করছেন। ভারতে আর কোথাও এটি নিয়ে কাজ হচ্ছে না, কেন?         
  • পারসি গারা এমব্রয়ডারি করতে একধরণের রঙিন সিল্কের সুতোর ব্যবহার করা হয়। ঠিক কেন এই সুতো দিয়েই পারসি গারা করা হয়? অন্য সুতো ব্যবহারে কি কি অসুবিধা হতে পারে? 
  • পারসি গারা ও পেতিত পয়েন্ট এমব্রয়ডারি এখনও পর্যন্ত হাতেই সেলাই করা হয়। এতে শ্রম এবং ব্যয় অনেক। নতুন যন্ত্র ব্যবহার করে এই সূক্ষ্ম মোটিফ বানানো কি সম্ভব?
  • পেতিত পয়েন্ট খুব পুরোনো একটি সেলাই। যুগের অবসানে সমস্ত বিষয়েরই পরিবর্তন হয়। সেক্ষেত্রে পেতিত পয়েন্ট এমব্রয়ডারির মধ্যে কি কি পরিবর্তন এসেছে? 
  • বর্তমানে ফিউশান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বাংলার নকশি কাঁথার সঙ্গে পারসি গারার ফিউশন কি সম্ভব? সেক্ষেত্রে এটির গ্রহণযোগ্যতাই বা কি? 

  • বেনারসির সঙ্গে পেতিত পয়েন্ট এম্ব্রয়ডারির মেলবন্ধন করা সম্ভব?

  • পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে যে সব এমব্রয়ডারি প্রচলিত তার মধ্যে কতগুলো ভারতে পাওয়া যায়? অবস্থান বিশেষে এদের ডিজাইনে কোনও পরিবর্তন হয় কি?

  • হাতে করা এমব্রয়ডারির নির্মাণ থেকে বিপণন বিদেশে কিভাবে হতে পারে?

  • কোন কোন এমব্রয়ডারি মেশিন করতে পারে না? কেন?

   

Reference -  

Gara Embroidery: A Primer  

What Is Petit Point Anyway? And Should You Try It? 

Parsi Gara Embroidery: A Timeless Indian Craft

The tale of parsi gara - A timeless tradition

Petit Point. What Is It? – Natalia's Fine Needlework

Meet the Man Reviving Two Dying Styles of Embroidery With Over 1200 Women  

Petit Point Embroidery: Definition, Techniques, and Creative Uses Explored

Reviving the legacy of 'Gara', exquisite embroidery of Parsis - Zoroastrians.net  

আরো উদ্যোগের খবর

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram