পাহাড়ি ক্যানভাস রঙ্গিন হচ্ছে চিত্তের ছেনি, হাতুড়িতেই

Saheli Mazumdar
November 29, 2024

পাহাড়ের গায়ে নকশা কেটেছেন চিত্ত দে। রুক্ষ-দেহে রঙ লেগেছে। এখন সেই পাহাড়ে ভীড় জমান ভ্রমণ পিপাসুরা। পুরুলিয়ার বলরামপুর এবং শ্রীরামপুর গ্রামের মধ্যবর্তী এলাকায় এই কাজ করেছেন চিত্ত । ১৯৯৫ সাল থেকে পাহাড়টিতে নকশা কাটার কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে চিত্তের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন আরো কত শিল্পকর্মী। এখন প্রায় ২৫ জন সহকারী তাঁকে সাহায্য করছেন। পাহাড় হয়ে উঠেছে রঙিন ক্যানভাস।

পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলি পাহাড় রয়েছে। তবে জঙ্গলঘেরা পাহাড় মানেই পুরুলিয়া। আদপেই শীতের পুরুলিয়া মোহময়ী। অগুন্তি পর্যটন কেন্দ্র গজিয়ে উঠেছে এদিক সেদিক। তারই মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চিত্ত দের “পাখি পাহাড়”। 

পাখি পাহাড় শুনলে মনে হতে পারে সেখানে বুঝি প্রচুর পাখির বাস।  পাখি আছে বটে। তবে জ্যান্ত নয়। চিত্ত-দের শিল্পী দল পাহাড়ের বুকে ৬৫ এর বেশি পাখির ছবি খোদাই করেছেন। এলাকাটি অযোধ্যা পাহাড়ের সংলগ্ন। কিছুদিন আগেও এখানে ছিলো বুলেট আর বুটের আনাগোনা।

পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে নকশা তৈরির এই পদ্ধতি হল “ইনসিটু শিলা ভাস্কর্য”। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই ধরণের কাজের দেখা মেলে। মহারাষ্ট্রের অজন্তা, ইলোরা, হাতি গুহা অন্যতম। দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ইনসিটু শিলা ভাস্কর্য রয়েছে। এর মধ্যে তামিলনাড়ুর মহাবলিপুরম, কর্ণাটকের বাদামী গুহা জনপ্রিয়। এছাড়া মধ্যপ্রদেশের ভিমবেটকা, সাঁচি, ওড়িশার উদয়গিরি ,খন্ডগিরি, ত্রিপুরার উনকোটিও ইনসিটু শিলা ভাস্কর্যের উদাহরণ।  

সাধারণত ভাস্কর্যশিল্পীরা বাছাই করা পাথরে কাজ করেন। পাথর নিয়ে এসে স্টুডিওতে কেটে নকশা তৈরি করেন। ইন- সিটু ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন নয়। এক্ষেত্রে পাথরটিকে যথাস্থানে রেখেই খোদাই করা হয়। পাখি পাহাড়েও ঠিক তাই করেছেন চিত্ত দে। বিভিন্ন আকৃতির পাখি ফুটিয়ে তুলেছেন পাহাড়ের গায়ে। 

পাখি পাহাড় পুরুলিয়ার প্রধান শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়টির উচ্চতা প্রায় ৮০০ মিটার। এটি অযোধ্যা পাহাড়ের একটি ছোট শৃঙ্গ। পাহাড়টিকে সংরক্ষণ করতে এর ওপর কারুকাজ শুরু করেন তিনি। পাহাড়ে খোদাই করেন রঙ বেরঙের পাখি। ১৯৯৭ সালে পান সরকারি সাহায্য। তাঁকে অনুরোধ করা হয় কয়েকজন ভাস্কর্যশিল্পীকে নিয়ে কাজ করার জন্য। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করার জন্যেই তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন।  

কাজ শুরুর প্রথম চার বছরে প্রায় পঞ্চাশ জনকে প্রশিক্ষণ দেন চিত্ত দে। অবশেষে পঁচিশ জনকে নিয়ে দলবদ্ধভাবে শুরু হয় মূল কাজ। খানিকটা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা পাহাড়ি ক্যানভাসে ছবি ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন। পাহাড়ের উপর থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় এনামেল রং ব্যবহার করে ছবিগুলো আঁকেন। ছেনি-হাতুড়ি সম্বল করে খোদাইয়ের কাজ করেন। ধীরে ধীরে ৬৫টি ডানামেলা পাখির ভাস্কর্য খোদাই করেন। এগুলির সবচেয়ে ছোটো ডানার দৈর্ঘ্য ৫৫ ফুট। সবচেয়ে বড়ো ডানার দৈর্ঘ্য ১২০ ফুট। প্রথমে পাহাড়টির নাম ছিল ‘মুরা বুরু’। ধীরে ধীরে পাহাড়টি ‘পাখি পাহাড়’ নামে পরিচিতি পায়।

পাখি পাহাড়ের চারদিকে ঘন জঙ্গল। শাল সেগুনে ভরা পাহাড়ি লাল রাস্তা। একসময় এটি জঙ্গি এলাকা হিসেবে  পরিচিত ছিল। এখন হয়ে উঠেছে পর্যটন কেন্দ্র।

পুরুলিয়া থেকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে মূল্যবান পাথর অবৈধভাবে পাচার হয়ে থাকে। গোটা এলাকাটাই গ্রানাইট শিলা অধ্যুষিত। ছোটনাগপুর মালভূমির অংশ। পাহাড়ি এলাকার বেশিরভাগ অংশই গ্রানাইটের। এই শিলা অত্যন্ত শক্ত। গ্রানাইটের মধ্যে - কোয়ার্টজ (২০%-৬০%), ফেল্ডসপার(৪০%-৮০%), মাইকা(৫%-১০%) থাকে। গ্রানাইটে পাথরে ছবি ফুটিয়ে তোলা কষ্টসাধ্যও বটে।

২অক্টোবর, ১৯৫৭ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন চিত্ত দে। পরিবার বিশেষ স্বচ্ছল ছিল না। ছয় ভাইবোনের সঙ্গে আর্থিক কষ্টেই বড় হন। তাঁর বাবা কোলিয়ারির ম্যানেজার ছিলেন। খুব সামান্যই ছিল আয়। ১৯৭৪ সালে পিতৃহারা হন। ছেলে চাকরি করুক এটাই চেয়েছিল পরিবার। কিন্তু তিনি শিল্পী হতে চেয়েছিলেন। প্রথমেই ভাস্কর্যশিল্প করবেন ভাবেননি। শুরু করেন থিয়েটার গ্রুপে মঞ্চ নির্মাণের কাজ। সেই সময়ে মাসে ১০০ - ১৫০ টাকা পেতেন তিনি। 

১৯৭৯ সালে, চিত্রকলায় ডিপ্লোমা কোর্স করার জন্য কলকাতার সরকারি আর্ট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে কোর্স শেষ করার পর সেট ডিজাইন করতে থাকেন । ১৯৯১ সালে একটি শিল্প প্রদর্শনীতে তিনি ২২ ফুট লম্বা ডানা সহ একটি পাখির ধাতব অবয়ব বানিয়েছিলেন। একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের দরজা ছোট ছিল। তাই ঢুকতে পারেনি পাখির মডেলটি। তখন মডেলটি আলাদা আলাদা মডিউলে ভেঙে নেন। পরে প্রদর্শনী শুরু  হলে আবার জুড়ে দেন।  এতো বড় মডেল পরবর্তী প্রদর্শনীতে রাখা যাবে না, সাফ জানিয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। এর থেকেই তিনি বুঝেছিলেন পেরেছিলেন একটি বড় ক্যানভাসের প্রয়োজন। 

সে বছরেই শুরু হয় পাহাড় খোঁজা। মহারাষ্ট্রের পশ্চিম ঘাট থেকে তামিলনাড়ুর বহু পাহাড়ে ঘুরে বেড়ান। অবশেষে পুরুলিয়ায় এসে শিল্পী তার বাসা খুঁজে পান। তিন বছরের বেশি সময় লেগেছিল এলাকাটি খুঁজে বের করতে।

পাহাড়ের গায়ে ভাস্কর্য শিল্পের জন্যে অর্থের প্রয়োজন। তাই সরকারি সাহায্য চেয়েছিলেন তিনি। তবে প্রথমেই সাহায্য পাওয়া যায়নি। অনুমতি পেতেই অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত। পরবর্তী চার বছর, ১৯৯৫-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত, তিনি প্রায় 32 জন স্থানীয় যুবককে পাহাড় খোদাইয়ের প্রশিক্ষণ দেন। প্রথমে তারা অনিচ্ছুক ছিল। কিন্তু কাজ শিখতে শিখতে তাদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ে। 

পাহাড় খোদাইয়ের অনুমতি থাকলেও ছিল না পর্যাপ্ত অর্থ। ২০০৮ সালে সরকার ১ কোটি টাকা অনুদান দেয়। শুরু হয় পাহাড়ি ক্যানভাসে কারুকাজ। প্রথম ভাস্কর্যটি আয়তনে ৬০০ ফুট x ৮০০ ফুট। কাজ শুরু হলেও রাজনৈতিক উত্তাপের জন্য পরবর্তী পাঁচ বছর ছেনি-হাতুড়ি স্তব্ধ ছিলোই বলা যায়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে ২০১৫ সাল নাগাদ। আবার পাহাড়ের গায়ে নকশা কাটতে শুরু করেন চিত্ত দে। এখনও হাতুড়ি চলছে। 

পাথরে প্রাণ দিতে শিল্পীকে শরীর মন নিঙরে নিয়ে কাজ করতে হয়। কঠিন গ্রানাইট কুঁদে পাখির ডানা গড়তে শরীরের জোর লাগে, ধৈর্য লাগে, সময় লাগে। অনেক সময় পাখির চোখের একটি ক্ষুদ্র অংশ তৈরী করতে মাস পেরিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে আবহাওয়ার ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 

পাখিগুলি আঁকতে সাদা, নীল এবং হলুদ রঙ ব্যবহার করেছেন চিত্ত দে। পাখি ছাড়াও এখন কচ্ছপ, ব্যাঙ, ময়ূর এবং কাঠবিড়ালি সহ বিপন্ন প্রাণীর অবয়ব আঁকা হচ্ছে। ছোট ছোট বোল্ডারের ওপর এই কাজ হচ্ছে। 

পাথর পাচার রুখতে ইনসিটু শিলা ভাস্কর্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পাহাড়ে কারুকাজ হলে অনায়াসে তা হয়ে উঠতে পারে পর্যটনকেন্দ্র। এর ফলে জনসমাগম বাড়ে। নিরাপত্তা বজায় থাকে। পাচারের ভয় কমে যায়। পাখি পাহাড়ের জন্যেই এলাকাটি বর্তমানে পুরুলিয়ার একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

পাখি পাহাড় তৈরির ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। উপকৃত হয়েছেন এলাকার জনজাতিরা। যারা দীর্ঘদিন জঙ্গলে প্রান্তরে জীবিকা খুঁজেছেন তারা শিল্প নির্মাণের বিশ্বকর্মা হয়ে উঠেছেন। নতুন প্রজন্মও আগ্রহ বাড়ছে। আগামীদিনে এই এলাকায় নতুন আরও কর্মসংস্থান গড়ে উঠতে পারে বলে আশা রাখেন স্থানীয়রা। 

ভাবার মত প্রশ্ন - 

  • পর্যটন ছাড়া আর কীভাবে এই এলাকায় কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব? সেক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের ভূমিকা কি হতে পারে? 
  • কীভাবে গ্রানাইটের গঠন অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হতে পারে? পাহাড়ি ভাস্কর্যশিল্পের ক্ষেত্রে এর কোনও প্রভাব পড়বে কি? 
  • সময়ের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সভ্যতা জুড়ে কীভাবে ইন-সিটু শিলা ভাস্কর্য পরিবর্তিত হয়েছে?
  • অঞ্চল বিশেষে ইন-সিটু শিলা ভাস্কর্য বিভিন্ন প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। এটি নানা রকমের লোকজ বিশ্বাস বহন করে। বর্তমান সময়ে তার বিশেষ কিছু পরিবর্তন হয়েছে কি? 
  • বিশ্বব্যাপী ইন-সিটু শিলা ভাস্কর্যের শৈলী এবং কৌশলগুলিতে কোন আঞ্চলিক পার্থক্য রয়েছে কি?
  • ইনসিটু শিলা ভাস্কর্যের জন্যে কেমন ধরণের এলাকা যথোপযুক্ত 

Reference - 

Artist Uses Ancient Art Technique on Rocks, Converts Maoist Area Into Tourist Hotspot

The Weekend Leader - Story of Chitta Dey, sculptor of Pakhi Pahar, Ayodhya Hills, Purulia, West Bengal 

rock art | Meet Chitta Dey, the artist behind Purulia’s Ayodhya Hills’ iconic Pakhi Pahar and Kana Pahar - Telegraph India

Pakhi Pahar(Places)(Ajoydha Circuit) 

Check out this artist’s cutting-etch rock art gallery - Hindustan Times

Chitta Dey carves granite hill into flock of birds in flight in West Bengal

Chitta Dey: Meet the rock artist of Bengal, who is on a mission to restore hills & plateaus of state

Rock Art History of India and Its Importance in Indian Archaeology: An Empirical Study

Rock Art of India – Pre and protohistoric cultures of India

আরো উদ্যোগের খবর

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram