“মিলেটের রাণী” হিসেবেই বিখ্যাত রায়মতী ঘুরিয়া। হারিয়ে যাওয়া দেশজ মিলেটের প্রজাতি সংরক্ষণ করেন রায়মতী। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে ৩০ রকমের বেশি দেশীয় মিলেট এবং ৭২ রকম দেশীয় ধান।
ভারতীয়দের খাদ্যতালিকায় মিলেট বেশ জনপ্রিয়। একসময় দেশের নানা প্রান্তে মিলেট দিয়ে নানা রকমের খাবার বানানোর রীতি ছিল। সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন আসে ভারতীয় খাদ্যাভ্যাসে। বদলায় দেশীয় রীতিনীতি। হারিয়ে যেতে থাকে দেশজ মিলেটের প্রজাতিগুলি।
সবুজ বিপ্লবের সময় থেকে বিলুপ্ত হতে শুরু করে মিলেটের দেশীয় প্রজাতিগুলি। ১৯৬০ এর দশকে উচ্চ ফলনশীল ধান ও গমের চাষবাস শুরু হওয়ায় হারিয়ে যায় দেশজ মিলেট। সেই সময়ে দরিদ্রদের খাদ্য হিসেবেই পরিচিত ছিল মিলেট। প্রধানত আদিবাসী এলাকায় হত মিলেট চাষ। বাড়তি লাভের আশায় মিলেট বন্ধ করে চা ও কফি চাষ শুরু করেন কৃষকরা। ধান বা গমের থেকে খানিক কষ্টসাধ্য মিলেট চাষ। তাই মহিলা কৃষকেরা মিলেট চাষে আগ্রহী ছিলেন না।
এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছেন রায়মতী ঘুরিয়া। ওড়িশার কোরাপুট জেলার নাগুড়া গ্রামে বাস তাঁর। ৩৬ বছর বয়সী রায়মতী ৩০ টির বেশি দেশজ মিলেটের প্রজাতি সংগ্রহ করেছেন। কুন্দ্র বতী মন্দিয়া (Kundra bati mandia), জাসরা (jasra), জুয়ানা (juyana), জামকলি (Jamkoli) তাঁর সংগ্রহের অন্যতম দেশজ মিলেটের প্রজাতি। এছাড়াও দেশীয় মিলেটের অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে কাঙ্গনি (হিন্দি) / কোরাল্লু (তেলেগু), সাওয়া / সানওয় (হিন্দি), সামাই (তামিল), চেনা (হিন্দি) অন্যতম।
মিলেট চাষের উপযুক্ত তাপমাত্রা ২০ - ৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তবে ১৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মিলেট চাষ সম্ভব। মিলেট চাষের জন্যে খুব কম জল প্রয়োজন । কিছু কিছু মিলেটের ক্ষেত্রে বছরে ৩৫ সেন্টিমিটার জলই যথেষ্ট। আবার কিছু মিলেটের ক্ষেত্রে সেই পরিমাপ হয় ৪০ সেমি। বেলে এবং দোআঁশ মাটিতে মিলেট চাষ ভালো হয়।
মিলেটের মধ্যে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ভরপুর। জোয়ার অর্থাৎ সরঘুমে সবথেকে বেশি কার্বোহাইড্রেট থাকে। প্রতি ১০০ গ্রামে ৭২.৬ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায় জোয়ারে। সবথেকে কম কার্বোহাইড্রেট রয়েছে কাওনে, প্রতি ১০০ গ্রামে ৬০.৯ গ্রাম। বর্তমানে কাওনের চাহিদা বাড়ছে। যারা ডায়েট করেন তারা নিজেদের খাবারে কাওন রাখছেন।
প্রোসো মিলেটে প্রোটিনের আধিক্য সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ গ্রামে ১২.৫ গ্রাম প্রোটিন মেলে। আবার, শ্যামা মিলেটে প্রোটিন সবচেয়ে কম, মাত্র ৬.২ গ্রাম। বাজরাতে ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ গ্রামে ৫ গ্রাম। সবচেয়ে কম ফ্যাট রয়েছে প্রোসো মিলেটে। প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ১.১ গ্রাম। প্রোসো মিলেট পেশির বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বাজরা দেহে এসেন্সিয়াল ফ্যাটি অ্যাসিডের জোগান দেয়।
বিভিন্ন খনিজ মৌল পাওয়া যায় মিলেটে। ১০০ গ্রাম রাগিতে ক্যালশিয়ামের পরিমাণ ৩৪৪ মিলিগ্রাম। শ্যামা মিলেটে আয়রনের পরিমাণ ৯.৩ মিলিগ্রাম। ১০০ গ্রাম বাজরাতে ফসফরাস থাকে ২৯৬ মিলিগ্রাম।
বাজরায় ক্যালশিয়ামের পরিমাণ বেশি। এটি অস্টিওপোরেসিস প্রতিরোধ করে। বিভিন্ন চিকিৎসকদের মতে শিশু, মহিলা এবং বৃদ্ধদের খাদ্য তালিকায় বাজরা থাকা অত্যন্ত জরুরী। বাজরায় রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া আয়রন থাকার ফলে রক্তাল্পতা কমাতেও সাহায্য করে। বাজরায় থাকা ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। কাঙ্গনি-র গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স কম। এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক রাখে। কুটকি দেহে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ায়। ফাইবার এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্টের উপস্থিতি ওজন নিয়ন্ত্রণ করে। সর্বোপরি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে মিলেটের জুড়ি মেলা ভার।
ভারতের সঙ্গে মিলেটের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ব্রোঞ্জযুগ (৪৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) থেকেই এটি ভারতের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ওড়িশার কোরাপুট, মালকানগিরি, রায়গাদা এবং নবরঙ্গপুরের জনজাতিরা শতাব্দী ধরে মিলেট চাষের সঙ্গে জড়িত।
বিশ্বের মধ্যে ভারত বৃহত্তম মিলেট উৎপাদক। সারা বিশ্বের মিলেট উৎপাদনের ৪১ শতাংশই হয় ভারতে। এফএও-এর তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ২০২০-তে মিলেটের উৎপাদন হয়েছিল ৩০.৪৬৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এর মধ্যে ভারতে উৎপাদন হয়েছিল ১২.৪৯ মিলেট মিলিয়ন মেট্রিক টন। ভারতে ২০২০-২১-এ মিলেট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৫.৯২ মিলিয়ন মেট্রিক টন।
রায়মতী তিরিশটির বেশি দেশীয় মিলেট প্রজাতি সংরক্ষণ করেছেন। এই কাজে রায়মতীর অনুপ্রেরণা পদ্মশ্রী কমলা পুজারি । ৭৬ বছর বয়সী কমলা ১০০ টির বেশি দেশজ ধানের প্রজাতি সংরক্ষণ করেছেন। কোরাপুট জেলার জৈব চাষেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর।
রায়মতী পড়াশুনা করেছেন সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত। এরপর মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়। তবে বাড়ির কাজে আটকে না থেকে মাঠে নামেন তিনি। পুঁথিভিত্তিক লেখাপড়ার থেকেও হাতে কলমে চাষবাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন রায়মতী।
বিয়ের পরে রায়মতী একনাগাড়ে চালিয়ে যান মিলেট চাষ এবং দেশীয় মিলেট সংরক্ষণ। পরবর্তী সময় চেন্নাইয়ের এম এস স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশনে মিলেট চাষের নতুন প্রযুক্তি শিখতে শুরু করেন। রায়মতী তাঁর গ্রামের বহু মহিলাকে স্বনির্ভর হতে শিখিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত প্রায় ২৫০০ কৃষককে মিলেট চাষের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
মিলেট রায়মতীর কাছে সোনার জাদুকাঠি। তাঁর সমস্ত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে মিলেট চাষের হাত ধরেই। বর্তমানে রায়মতী একটি স্ব- সহায়ক দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। গ্রামের মহিলা মিলেট কৃষকরাই এই দলের সদস্য। মূলত মিলেট ব্যবহার করে পকোড়া এবং লাড্ডু তৈরি করেন। পরে জিনিসগুলি বিক্রি হয় স্থানীয় বাজারে। এর থেকে যে মুনাফা আসে তা ভাগ করে নেন দলের সদস্যারা। রায়মতী নিজের পৈতৃক জায়গায় একটি বিদ্যালয় বানিয়েছেন। মিলেট চাষ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয় এখানে।
ভারতের মধ্যে ওড়িশাতেই একমাত্র চারটি বিরল প্রজাতির মিলেট পাওয়া যায়। এগুলি হল - কুন্দ্রবতী, লক্ষ্মীপুর কালিয়া, মাল্যবন্ত মামি এবং গুপ্তেশ্বর ভারতী। ওড়িশার আবহাওয়া এই জাতীয় মিলেটের জন্যে যথোপযুক্ত।
ওড়িশায় দেশীয় মিলেট সংরক্ষণের প্রক্রিয়ায় রায়মতীর উদ্যোগের পাশাপাশি কৃষক, কৃষিবিদ এবং গবেষণা সংস্থাগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে বলতে হয় এমন কিছু কৃষকদের কথা, যারা দীর্ঘ সময় মিলেট চাষের সঙ্গে যুক্ত। এই কৃষকরা পারিবারিক সূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেশীয় মিলেটের প্রজাতি সংরক্ষণ করছেন। মহিলা কৃষকরাও মিলেট চাষে এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা যেমন ওড়িশার কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশীয় মিলেট প্রজাতি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চালাচ্ছে। ওড়িশা সরকারও মিলেট চাষকে উন্নত করতে “ওড়িশা মিলেট মিশন” শুরু করেছে।
“ওড়িশা মিলেট মিশন” শুরু হয় ২০১৭ সালে। এই মিশন চালু করার প্রধান লক্ষ্য ছিল মিলেট চাষকে অগ্রাধিকার দেওয়া। পাশাপাশি মিলেট ব্যবহার এবং রপ্তানি বাড়ানো। এই মিশনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য - আদিবাসী অঞ্চলে মিলেট চাষ বাড়ানো, কৃষকদের স্বনির্ভর করা, দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় মিলেটের অন্তর্ভুক্তিকরণ, সরকারি প্রকল্পে (মিড - ডে মিল) মিলেটের ব্যবহার। এই প্রকল্পের আরেকটি মূল উদ্দেশ্য মিলেট দিয়ে তৈরি খাদ্যদ্রব্যের প্রচার।
সমীক্ষা অনুযায়ী প্রথমে ওড়িশার মিলেট চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক ছিল না। ২০১৭ - ২০১৮ সালে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় ১২ হাজার ৫৮৯ টাকার ক্ষতি হয়। এর থেকে ন্যূনতম উৎপাদন খরচও লাভ করতে পারেন নি কৃষকরা। বর্তমানে পরিস্থিতি বদলেছে। ওড়িশা মিলেট মিশন ২০২১- ২২ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৩ লক্ষ ২৩ হাজার কুইন্টাল মিলেট উৎপাদন করেছেন ৪১ হাজার ২৮৬ জন কৃষক। এই উৎপাদন থেকে উল্লেখযোগ্য হারে লাভ করেছেন কৃষকরা।
২০২৩ সালের জি- ২০ আর্থ সামিটে রায়মতী তাঁর উৎপাদিত দেশীয় মিলেট প্রজাতিগুলির প্রদর্শন করেন। বিশ্ববাসীর কাছ থেকে অকুন্ঠ প্রশংসাও পান। নতুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে জৈব চাষের নতুন দিগন্তে পৌঁছানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
ভাবার মত প্রশ্ন -
Reference -
They Call Me 'Queen of Millets': How One Woman is Preserving Rare Indian Millets
Odisha's Millet Landraces Legacy: Pioneering Millet Varieties Enriching Sustainable Agriculture
Koraput tribal woman to attend G20 meet to promote millets | YourStory
Millet Economy of Odisha: How Far It is Viable and Sustainable?