হাজার পুকুর বানিয়েছেন লীলাবতী মাহাতো

Saheli Mazumdar
November 8, 2024

খরা - প্রবণ এলাকায় ১০০০ এর বেশি বৃষ্টির জল সংরক্ষক পুকুর বানিয়েছেন লীলাবতী মাহাতো। সঞ্চিত জল ব্যবহার করে মৌসুমি ফসলের চাষ করেছেন তিনি। বর্তমানে তরমুজ চাষের প্রতিও ঝোঁক বাড়ছে এই এলাকায়। বৃষ্টির জল সংরক্ষক পুকুর বা ট্রেঞ্চে মাছচাষ করেও জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকেই। এই জলেই দেশজ ধানের চাষ করে গ্রামের মহিলারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছেন। 

ঝাড়গ্রামে কয়েক বছর আগেও পৌঁছয়নি নগর সভ্যতার ছোঁয়া। ২০১৭ সালে ছোট নাগপুর মালভূমির এই অংশটি পশ্চিম  মেদিনীপুর জেলা থেকে আলাদা হয়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গের ২২ তম জেলা হয়ে ওঠে ঝাড়গ্রাম। জেলাটির মাত্র ৩% মানুষ শহরে বাস করেন। বাকি জনবসতি গ্রামে।  

ঝাড়গ্রামের আবহাওয়া শুষ্ক। এটি অত্যন্ত খরাপ্রবণ এলাকা। ছোটনাগপুর মালভূমি ঢালু হয়ে সমভূমির সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় ল্যাটেরাইট মাটি ক্ষয়ে জেলাটি তৈরি হয়। জুন থেকে সেপ্টেম্বরে ঝাড়গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বৃষ্টি হয়। জুলাই ও আগস্ট মাসে এই এলাকায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত  প্রায় ১,৪০০ মিমি। 

বার্ষিক  ১৪০০ মিমি বৃষ্টি হলেও এই জল চাষে ব্যবহার হত না। মূলত ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহার করেই চাষ ও অন্যান্য কাজ করতেন এলাকাবাসী। এছাড়া মাটির প্রকৃতি অনুযায়ী কেবল ধানের চাষ করতেন কৃষকরা। বছরের বাকি সময় তারা জঙ্গল থেকে লাঠি, মধু, ফল, ঔষধি গাছ সংগ্রহ করতেন। আবার অনেকে বানাতেন পাটের দড়ি। ঝাড়গ্রাম ঢালু হওয়ায় এখানে বর্ষার জল স্থায়ীভাবে দাঁড়ায় না।  উপযুক্ত জলের জোগান না থাকায় অন্য ফসলও চাষ করা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে জীবন জীবিকা একপ্রকার অনিশ্চিত। 

২০১১ সালে লীলাবতী স্ব-সহায়ক দলে যুক্ত হন। দলটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১০। লীলাবতী নেতৃত্ব দেন দলটির। এখানেই কৃষিকাজ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় শিখতে শুরু করেন তিনি। 

২০১৪ সালে লীলাবতী যুক্ত হন PRADAN (প্রফেশনাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যাকশন) এর সঙ্গে। এটি একটি বেসরকারী অলাভজনক সংস্থা। PRADAN কৃষিকাজ, পশুপালন, মৎস্যচাষ, মহিলদের স্বনির্ভরতা নিয়ে কাজ করে। ১৯৮৩ সালে PRADAN দিল্লীতে প্রথম স্থাপিত হয়। এখন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামে PRADAN কাজ করছে। ঝাড়গ্রামের বিনপুর ১, বিনপুর ২, গোপী ব্লকে অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় PRADAN কাজ করছে। 

বিনপুর 2 ব্লকের ধোবাখুরিয়া গ্রামে গৃহবধূ ছিলেন লীলাবতী। সেই সময়ে চাষবাস এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হত ভূগর্ভস্থ জল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পরিকল্পনা করেন প্রাকৃতিক উপায়ে জল সংরক্ষণের। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে এলাকাবাসীর সমর্থন জরুরি বুঝেছিলেন লীলাবতী। সাধারণ মানুষের ভ্রান্ত ধারণা, পুকুর কাটলে বা ট্রেঞ্চ করলে জমি অনুর্বর হতে পারে। এই ধারণা ভাঙাতেও ক্রমাগত প্রচার চালিয়েছেন লীলাবতী। 

PRADAN এর সহযোগিতা ও লীলাবতীর উদ্যোগে গ্রামের মহিলারা  জল সংরক্ষণের জন্যে পুকুর কাটতে শুরু করেন। খরার সময়ে সংরক্ষিত জল ব্যবহার করে তারা সবজি চাষ করে উপকৃত হয়েছেন। UNDP (ইউনাইটেড নেশনস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট) এর প্রকাশনা, “A compendium of 41 Women Stewards” লীলাবতীকে 'ওয়াটার চ্যাম্পিয়ন' হিসাবে উল্লেখ করেছে।

বর্তমানে করলা চাষ বেড়েছে এই অঞ্চলে। এছাড়া তরমুজ চাষ করেও উপকৃত হচ্ছেন কৃষকরা। দেশজ ধানের চাষ করে লাভবান হচ্ছেন ঝাড়গ্রামের মহিলা কৃষকরা। দেশজ ধানের প্রজাতির মধ্যে বাদশাভোগ, কালাভাত, কেরালাসুন্দরী এই প্রজাতিগুলি চাষ হয়। সময়ের সঙ্গে বাড়ছে দেশজ ধানের চাহিদা। কম খরচে দেশজ ধানের চাষ সম্ভব। ব্যবসায়িক দিকেও বাড়ছে তাই লাভের পরিমাপ। 

 ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয় লীলাবতীর। কলেজে পড়ার সময় দুই সন্তানের জন্ম দেন। ছাড়তে হয় পড়াশুনো। খুঁজতে হয় স্বামী সন্তানসহ অন্য ঠিকানা। রোজগারের জন্য শুরু করেন কৃষি জমিতে শ্রমিকের কাজ। ২০১১ সালে যুক্ত হন স্ব-সহায়ক দলে। অল্প অল্প করে সঞ্চয় করতে শুরু করেন। তাঁর স্বামী চাকরি সূত্রে টাটানগরে চলে যান। সেখান থেকে তিনি তাঁর উপার্জনের কিছু অংশ লীলাবতীকে পাঠান। ২০১৬ সালে লীলাবতী তাঁর স্ব- সহায়ক দল থেকে কিছু টাকা ধার নেন। লিজে নেন তিন বিঘা জমি। এই জমিতেই চাষ করে চার মাসে আয় করেন ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা। লীলাবতীর সাফল্য দেখে উজ্জীবিত হন মহিলারা। গ্রামের পুরুষরাও তাঁর কাছ থেকে সবজি চাষের বিষয়ে পরামর্শ নিতে শুরু করেন। 

PRADAN  এর সহযোগিতায় বৃষ্টির জল সংরক্ষক পুকুর বানানোর কাজ এখনও চলছে বলে জানিয়েছেন লীলাবতী। ২০২৩ - ২৪ বর্ষে মোট ৬০ টি পুকুর বানানো হয়েছে। ২০০ টির বেশি পুকুর বানানোর মনোনয়ন জমা পড়েছে দপ্তরে। PRADAN বিভিন্ন সংস্থার সহযোগে অর্থ সংগ্রহ করে এই কাজ করে। 

পুকুর কাটা ছাড়াও বৃষ্টির জল ব্যবহার করার অন্যান্য পদ্ধতি রয়েছে। যেমন - স্ট্যাগ্যার ট্রেঞ্চ, ৩০/৪০ জল সংরক্ষক কাঠামো। এক্ষেত্রে  ওয়াটার শেড(উঁচু জায়গা থেকে জল ভাগ হয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে বের হয়), রিজ লাইন, নিকাশি নালা তৈরি করা হয়।  উঁচু জমিতে বৃষ্টির জলের গতিবেগ বেশি। ফলে নিম্নভূমিতে সেই জল প্রায় পৌঁছয় না। নিম্নভূমিতে জলের জোগান ঠিক রাখতে  মাটির নীচ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ বানানো হয়। এই পথ মেশে পুকুর বা ট্রেঞ্চে। এক্ষেত্রে অপচয় কম হয় জলের। কমে ভূমিক্ষয়। 

প্রত্যেকটি কাঠামো বানাতে নির্দিষ্ট পরিমাপ ব্যবহার করা হয়। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতা খাতায় কলমে কষে নিয়েই কাজে নামেন লীলাবতীরা। এক একটি ট্রেঞ্চ বানাতে দুজন করে শ্রমিক মাটি কাটার কাজ করেন। কমপক্ষে ৩ দিন সময় লাগে একটি জল সংরক্ষক কাঠামো বানাতে।

PRADAN এর সমর্থনে লীলাবতী কৃষকদের চাষবাসে সাহায্য করেন।  কীভাবে বীজ বপনের আগে মাঠ প্রস্তুত করতে হয়, মালচিং পদ্ধতি ব্যবহার করে মাটির আর্দ্রতা কীভাবে বজায় রাখতে হয়, ভার্মি কম্পোস্ট দিয়ে কীভাবে মাটিতে পুষ্টির জোগান  হয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ করতে হয়। 

ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণ নিয়েই লীলাবতীর সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালে ঝাড়গ্রামের ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যেতে থাকে। ভূগর্ভের জল সংরক্ষণ করতে মাঠে নামেন লীলাবতী ও তাঁর প্রমিলাবাহিনী। লীলাবতী বুঝেছিলেন ভূগর্ভের জলস্তর ঠিক রাখতে পুকুর নির্মাণের থেকে ভালো উপায় আর কিছু হতে পারেনা। 

পুকুর করতে গেলে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তা জরুরি। প্রাথমিকভাবে সাহায্য পাননি লীলাবতী। পরে গ্রামবাসীর চাপে পুকুর করতে বাধ্য হয় পঞ্চায়েত। সাহায্য আসে PRADAN থেকেও। 

৮৫টি গ্রামের ১২৫০টি পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জল সংরক্ষণের কাজ করেছে। লীলাবতীর তত্ত্বাবধানে ১০০০ এর বেশি স্ট্যাগারিং ট্রেঞ্চ, কন্টার বান্ড, ফিল্ট্রেশন পিট, সিপেজ ট্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে। 

বর্তমানে ঝাড়গ্রামে জৈবিক উপায়ে তরমুজ উৎপাদন হচ্ছে। উৎপাদিত তরমুজ PRADAN এর মাধ্যমেই বাজারে পাঠানো হয়। তরমুজ চাষ  করে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।  

কৃষি ছাড়াও ঝাড়গ্রামে শুরু হয়েছে মৎস্যচাষ।  পুকুরগুলিতেই বিভিন্ন মাছ চাষ শেখানো হচ্ছে। কম খরচে মাছ চাষ করে লাভ করছেন তারা। 

মাছচাষের পাশাপাশি PRADAN এর উদ্যোগে পশুপালন করছেন ঝাড়গ্রামবাসী। প্রাণীজ দ্রব্য বিক্রি করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকেই। 

বর্তমানে মাছচাষ বা প্রাণী পালনের ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন অনেকেই। মাছের রোগ হলে ওষুধ পাওয়া যায়না। ফার্মে মড়ক লাগলে আর্থিক ক্ষতি হয়।  যথাযথ বাজার না থাকায় পালন করা ভেড়া, মুরগী, ছাগল কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন অনেকেই। এই বিষয়ে আরও কাজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন লীলাবতী। 

সাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে চলেছেন লীলাবতী। গ্রামের মানুষের বার্ষিক আয় বাড়াতেও উদ্যোগী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। গ্রাম পঞ্চায়েতগুলিকে রোগমুক্ত রাখতে আগামীদিনে কাজ করতে চান বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।


ভাবার মত প্রশ্ন - 

  • ঝাড়গ্রামের মাটিতে মাশরুম চাষ সম্ভব। কীভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে কোনও রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই এই এলাকায় মাশরুম চাষ করা যেতে  পারে? 

  • ঝাড়গ্রামের ভূগর্ভস্থ জলের স্তর শতকরা ৩০.৩৩ - ৫০.৮১। দিন দিন এই জলস্তর কমতে শুরু করেছে। কীভাবে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এই জলস্তর সুরক্ষিত করা সম্ভব ?

  • ঝাড়গ্রামের ল্যাটেরাইট মৃত্তিকা। এই মাটিতে আল্যুমিনিয়াম এবং লোহার উপস্থিতি সর্বাধিক। এই মাটি কফি, রাবার চাষের পক্ষে অত্যন্ত উত্তম। কিন্তু এই অঞ্চলে কফি বা রাবার চাষ করেন না কৃষকরা। কেন? 

  • ঝাড়গ্রামে বিভিন্ন রকমের ঔষধি গাছের খোঁজ মেলে। এর থেকে নানা দুর্মূল্য ঔষধ বানানো সম্ভব। এই বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন । 

References - 

Unsung Woman Helps Parched Village Build Over 1000 Water Saving Structures 

Women Water Champions 

Lilabati Mahata mobilizes rural women to build water conservation structures - Times Applaud


লড়ছেন লীলাবতী মাহাতো

আরো উদ্যোগের খবর

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram