মাঠে নয়, সবজি ফলছে এখন পুকুরে। জলাশয়ের ওপর সবজি চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন হিরোদ পাটেল। অভিনব চাষের এই পদ্ধতি দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসছেন কৃষিপ্রেমীরা।
সবজি ক্ষেত বললে প্রথমেই মাথায় আসে সবুজের সমাহার। আর ক্ষেতের মধ্যেই থাকে যদি ছোট্ট ছোট্ট পুকুর ! যেখানে শীতের সোনালী রোদ পড়ে চকচক করছে। আর এই পুকুরগুলির ওপরেই যদি চাষ হয় করলা, উচ্ছে, শশা, লাউ! বিষয়টা এটুকুই নয়, সমান তালে যদি হয় মাছচাষও? তাহলে? দৃশ্যটা কল্পনা করা যাচ্ছে তাই নাহ? এই গোটা বিষয়টির বাস্তবায়ন করেছেন ৩২ বছরের হিরোদ পাটেল। হিরোদের বাড়ি ওড়িশার সুন্দরগড়ে। তিনি অভিনব এই কৃষিপদ্ধতির ব্যবহার করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন।
হিরোদ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং কোর্স করেছেন। তবে চাকরির বদলে বেছে নিয়েছেন চাষবাস। এখন সবজি ফলিয়েই বছরে আট লক্ষ টাকা আয় করছেন। শিরোপা পেয়েছেন agri-entrepreneur এর।
হিরোদের ছয়জনের পরিবার। তাঁর বাবা শিবশঙ্কর প্যাটেল অবসর সময়ে চাষের কাজ করতেন। সেখান থেকেই তাঁর চাষবাসের প্রতি ঝোঁক বাড়ে। খুব সামান্য মূলধন নিয়েই চাষ শুরু করেন। প্রথমে তাঁর কাছে ছিল মাত্র এক একর জমি। পরে লাভের পরিমাণ বাড়তে থাকে। এখন নয় একর জমির মালিক হিরোদ।
চাষের অত্যাধুনিক পদ্ধতি শিখতে হিরোদ মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। সেখানে সরকারি উদ্যান বিভাগ থেকে কলা চাষের অভিনব পদ্ধতি শিখে আসেন। ঠিক করেন নিজের জমিতেই চাষ শুরু করবেন। শুধুমাত্র জমিতে চাষ করে সর্বাধিক লাভ পাওয়া সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে জমির মধ্যে পুকুর খনন করে মাছচাষ এবং উল্লম্ব সবজি চাষ করলে লাভের হার বাড়তে পারে। এই চিন্তাভাবনা থেকেই পুকুরের ওপর চাষ শুরু করলেন হিরোদ।
পুকুরে ফলছে সবজি! ভাবতেই অবাক লাগে তাই নাহ? বিষয়টা আক্ষরিক অর্থে একটু ভিন্ন। জলের সঙ্গে লাগোয়া নয় বরং পুকুরের ওপর একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় সবজিগুলি ফলানো হয়। ঝুলন্ত অবস্থায় সবজি চাষকে বলে ট্রেলিস পদ্ধতি। এটি ভারতের অত্যন্ত প্রাচীন একটি কৃষি পদ্ধতি। আগে ট্রেলিস হতো বিভিন্ন বাগানে। বর্তমানে বহুল প্রচলিত ড্রাগন ফলের চাষও ট্রেলিস পদ্ধতিতেই হয়।
ট্রেলিসকে অভিনবত্বের ছোঁয়া দিয়েছেন হিরোদ। মাটি নয়, জলাশয়ের ওপর বাস্তবায়ন করেছেন পদ্ধতিটির। এক্ষেত্রে জলাশয়ের সঙ্গে সবজিগুলোর নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় থাকে। ওই একই জলাশয়ে মাছচাষও করছেন হিরোদ। প্রান্তিক চাষিদের বছর শেষে মুনাফার হার নগণ্য। তাদের জমির পরিমাণও কম। সেক্ষেত্রে একই জমিতে সবজি এবং মাছচাষ করলে তারা লাভবান হবেন। এই চিন্তাভাবনা থেকেই জলাশয়ের ওপরে ট্রেলিস শুরু করেন হিরোদ।
ট্রেলিস বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কখনো এটি নরম জমিতে করা হয়, কখনো বাগানে তো কখনো আবার জলাশয়ের ওপর। মাছচাষের ফাঁড়ির ওপর ট্রেলিস করলে একই জায়গায় দুই ধরণের বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়। একটি কৃষিজ বাস্তুতন্ত্র, অপরটি জলজ বাস্তুতন্ত্র। ট্রেলিস পদ্ধতিতে চাষ করতে প্রয়োজন বাঁশ ও নাইলনের দড়ি। খুব সামান্য খরচে প্রাকৃতিক উপায়ে ট্রেলিস সম্ভব। যদি জলাশয়ের ওপর ট্রলিস করা হয় সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দূরত্বে বাঁশগুলি লাগাতে হবে। ওই বাঁশগুলির ন্যূনতম দূরত্ব হতে হবে ১.৮ মিটার। এবার প্রশ্ন আসতেই পারে কেন ১.৮ মিটার দূরত্বই রাখেন চাষিরা? আসলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ফসলের বৃদ্ধি, বায়ু চলাচল এবং সূর্যালোক প্রবেশের জন্য এই দূরত্ব যথেষ্ট। ট্রেলিসের জন্যে জলাশয় থেকে সবজিগুলির একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় থাকা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ১.৫ মিটার উচ্চতা উপযুক্ত। ট্রেলিসের জন্যে জালও প্রয়োজন। নাইলনের দড়ি দিয়ে দুটি পোস্ট বা বাঁশগুলি বাঁধা হয়। মাঝে লাগানো হয় জাল। এরফলে গাছগুলি ওই জালের মধ্যেই বড় হয়। মূলত কুমড়ো, শশা, লাউ, করলা ট্রেলিস পদ্ধতিতে চাষ হয়।
এধরণের উল্লম্ব চাষের ক্ষেত্রে গাছগুলি জলাশয় থেকেই প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা পায়। চাষের কাজেও এই জল ব্যবহার করা হয়। মূলত ড্রিপ সেচ উল্লম্ব চাষের জন্যে উপযুক্ত একটি পদ্ধতি। পাশাপাশি, ফাঁড়ির জলে মাছচাষ করার ফলে মাছের উৎপাদিত বর্জ্য ওই জলের সঙ্গেই মিশে থাকে। এই সমস্ত বর্জ্যের মধ্যে নাইট্রোজেন এবং ফসফরাস থাকে। ফলে এই জল চাষের কাজে ব্যবহার করা হলে ফসলের বৃদ্ধি ভাল হয়। উপরন্তু কোনও রাসায়নিক সারের প্রয়োজন পড়েনা। আবার সবজি চাষের ফলে পুকুরের ওপরে ছাউনি বা আস্তরণ তৈরি হয়। সূর্যের আলো সরাসরি জলের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে, ফাঁড়ির জল তুলনামূলক ঠান্ডা হয়। ঠাণ্ডা জল কম বাষ্পীভূত হওয়ায় অক্সিজেনের চাহিদাও স্বাভাবিক থাকে। ঠাণ্ডা জল মাছ চাষের অত্যন্ত উপযোগী।
জলাশয়ের ওপর উল্লম্ব চাষের বেশ কয়েকটি সুবিধা রয়েছে। এই চাষে উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ হয়। মাঠে চাষ করলে এক হেক্টর জমিতে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার গাছের চারা লাগানো সম্ভব। সেক্ষেত্রে দুটি গাছের সারির মধ্যে ২ মিটারের ব্যবধ্যান থাকে। একটি গাছ থেকে আরেকটি গাছের দূরত্ব হয় ০.৫ - ১ মিটার।
ট্রেলিস চাষের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ অনেকটা বেড়ে যায়। দুটি গাছের সারির মধ্যে ব্যবধ্যান থাকে ১.৮ মিটার থেকে ২ মিটার। একটি সারির দুটি গাছের মধ্যে দূরত্ব হয় ০.৫ মিটার থেকে ১ মিটার। ১ হেক্টর ট্রেলিসে গড়ে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার গাছ লাগানো সম্ভব। যদিও গাছের প্রকৃতি অনুযায়ী এই সংখ্যার হেরফের হয়। করলার ক্ষেত্রে ১ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার গাছই লাগানো সম্ভব। শশা গাছের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা হয় ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার। বিনসের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা হয় ১৫ হাজার থেকে কুড়ি হাজার।
ট্রেলিস পরিবেশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ট্রেলিসের ফলে কোনও কার্বন উৎপন্ন হয়না। সাধারণত মাছচাষ এবং সবজি চাষ দুটি ভিন্ন উপায়ে হয়। সেক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও নানা রকমের যন্ত্রপাতিও ব্যবহৃত হয়। ট্রেলিসের ক্ষেত্রে এগুলির প্রয়োজনীয়তা নেই। মাছের উৎপাদিত বর্জ্যই জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া খুব সাধারণ জিনিস যেমন বাঁশ, দড়ি ইত্যাদি দিয়েই ট্রেলিস করা যেতে পারে। কোনও যন্ত্রপাতির বিশেষ প্রয়োজন নেই। চাষজনিত বিভিন্ন কাজ কৃষকরাই করে থাকেন।
ট্রেলিসের জন্যে ছোট্ট এলাকাতেও জীববৈচিত্রের নানা ধরণ দেখা যায়। ওপরে ঘন গাছের ছাউনি থাকায় জলাশয়ের মধ্যে মাছ এবং বিভিন্ন পতঙ্গের বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়। আবার ফসলের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে মৌমাছি, প্রজাপতি এবং পাখিরাও ওই এলাকায় ভিড় জমায়।
ট্রেলিস ভারতে অত্যন্ত প্রাচীন একটি চাষের পদ্ধতি। দক্ষিণ ভারতে এটি প্যান্ডাল চাষ নামে পরিচিত। সমগ্র ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এখনও ট্রেলিস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, মিজোরাম, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটক অন্যতম। রাজস্থান এবং তামিলনাড়ুর মতো খরাপ্রবণ রাজ্যে জলাশয়ের ওপর ট্রেলিস অত্যন্ত সহায়ক চাষের পদ্ধতি হতে পারে।
ট্রেলিস পদ্ধতি চাষিদের অত্যন্ত সহযোগী। ট্রেলিসের ব্যবহার বাড়াতে সরকার এবং এনজিও এর বড় ভূমিকা থাকা প্রয়োজন বলেই মনে করেন কৃষিবিদরা। সেক্ষেত্রে সরকারের তরফে বিভিন্ন সচেতনতামূলক ক্যাম্পেন করা প্রয়োজন। হাতে-কলমে ট্রেলিস কি, কিভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সর্বাধিক ফসল উৎপাদন সম্ভব তা বোঝানো যেতে পারে কৃষকদের। ট্রেলিসের উৎপাদিত ফসল কীভাবে বাজারজাত করলে মুনাফা বেশি হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত।
হিরোদ নিজের তাগিদে এই সমস্ত বিষয় জেনেছেন। তিনি লাউ, করলা, শশা এবং অন্যান্য সবজি চাষ করেন যেগুলির বাজারে ভালো চাহিদা রয়েছে। এই ধরণের সবজিগুলো মাত্র ৬০ থেকে ৯০ দিনের মধ্যেই ফসল দিতে পারে। সবজিগুলোর মাটির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না থাকায় কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হয়। ফসলগুলি জৈবিক উপায়ে উৎপাদিত হওয়ায় জিনগত রোগ প্রায় হয়না বললেই চলে। উল্লম্ব চাষে ফসলগুলি সর্বাধিক সূর্যালোক পায়। যথোপযুক্ত সূর্যালোক সবজির আকার, রঙ এবং স্বাদের তারতম্য ঘটাতে পারে। ট্রেলিসের ব্যবহারে ক্ষুদ্র চাষিরা তাই দারুণ উপকৃত হতে পারেন।
ট্রেলিসের জন্যে উর্বর জমির প্রয়োজন নেই। যে সমস্ত নিম্নভূমি রয়েছে সেখানেই ট্রেলিস করা যেতে পারে। ২০১৯ সালে কৃষি বিভাগের মৃত্তিকা সংরক্ষণ ও জলাশয় উন্নয়ন দপ্তরের সহায়তায় হিরোদ নিজের জমিতেই তিনটি পুকুর খোঁড়েন । এরমধ্যে একটি পুকুর ৪,৩৫৫.৬০ বর্গফুট এলাকায় খোঁড়া হয় MNGREGA প্রকল্পের আওতায়। এই পুকুরটির ওপরেই মূলত ট্রেলিস চাষ করা হয়। বাকি দুটি পুকুরে চাষ হয় তেলাপিয়া এবং শিঙ্গি মাছ। শুধু তাই নয়, হিরোদের বাগানে নানা রকমের ফলের গাছও রয়েছে। সঙ্গে রয়েছে ৩৫০টির বেশি নারকেলের গাছ।
হিরোদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা গ্রামের ক্ষুদ্র ভাগচাষিদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। আগামীদিনে চাষাবাদের আরও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবেন বলে আশা রাখেন হিরোদ প্যাটেল।
ভাবার মতো প্রশ্ন -
Reference -
Farmer's Unique Model Helps Him Grow Vegetables Over Ponds, Inspires Others
Sundargarh’s Hirod Patel Shows the Way for Farmers’ Growth & Empowerment
Young Sundergarh Farmer Grows Happiness From Farm Ponds, Turns Role Model For Others | Odisha
ITI Passout Picks Farming Over Job | Success Story | Bhubaneswar News - Times of India
Pond Cultivation: This Farmer Grows Vegetables Over Ponds - See Positive
Farmer harvests profit from unique farm pond idea
This Sundergarh Youth Makes A Fortune In Modern Farming | Odisha
32-Year-Old Farmer Yields Profit from Unique Farm Pond Idea
(PDF) Sustainable aquaculture in ponds: Principles, practices and limits
(PDF) Design and Performance Analysis of Rural Aquaculture Ponds using IoT