ত্রয়ী - মেয়েদের স্বপ্নপূরণের অন্য ঠিকানা

Saheli Mazumdar
February 25, 2025

ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়িতে বসেই একরাশ স্বপ্ন বুনছেন তিন মহিলা। বানিয়েছেন নিজেদের ব্যবাসায়িক প্রতিষ্ঠান ত্রয়ী। লীলাবতী মাহাতো, সুরঞ্জনা মাহাতো এবং কাকলি মাহাতো গত তিন বছর ধরে ব্যবসাটি গড়েছেন। 

ত্রয়ী ঝাড়গ্রাম ভিত্তিক একটি ব্যবসায়িক সংস্থা। বেলপাহাড়ির মহিলারাই মূলত এই ব্যবসার মেরুদন্ড। বর্তমানে ত্রয়ী বেশ কয়েকটি জিনিস নিয়ে ব্যবসা করছে। যাদের মধ্যে অন্যতম বাড়িতে বানানো কুল, জলপাই এবং বিভিন্ন সবজির আচার। এছাড়াও দেশি ধানের আতপ চাল, চিঁড়ে, ভেজালবিহীন হলুদ, শালপাতার থালা, বাবুই ঘাসের ঘর সাজানোর জিনিস এই ব্যবসার নজরকাড়া সম্ভার। 

বেলপাহাড়ির আদি বাসিন্দাদের আজও জীবন জীবিকা নির্ভরশীল জঙ্গলের ওপর। তাই আঞ্চলিক মহিলারাও জঙ্গলকেই বেছে নিয়েছেন তাদের রুজি রুটির জন্যে। 

ত্রয়ীর যাত্রাপথ শুরু হয় লকডাউনের সময় থেকে। করোনার প্রকোপে তখন গ্রামের ছোট ছোট কুঁড়ে ঘরগুলিতে দেখা দিয়েছে অভাব। সাধারণ নিত্য নৈমিত্তিক খরচ চালানোর জোগাড় কীভাবে হবে ভেবে কূল পাচ্ছেন না গৃহকর্তৃরা।  টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট বলছে, পরিযায়ী শ্রমিকের নিরিখে গোটা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ চতুর্থ স্থানে রয়েছে। ভারতের মোট পরিযায়ী শ্রমিকের ২০% শ্রমিকই বঙ্গের। 

যেকোনও ব্যবসার ইউএসপি বা অনন্যতা ভীষণ জরুরী। ত্রয়ীর ক্ষেত্রে এটি গ্রাম্য সাধারণ নির্ভেজাল সামগ্রী। ত্রয়ীর সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন ১৫ জন মহিলা। এরা সকলেই কোনও না কোনও স্ব-সহায়ক দলের অঙ্গ। স্ব- সহায়ক দলে মহিলাদের নানা ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর মধ্যে, উন্নত এবং জৈবিক উপায়ে কৃষি, হস্তশিল্পের কাজ, বুনন শিল্প, কুটির শিল্প অন্যতম। প্রত্যেকটি স্ব -সহায়ক দলের মহিলারা প্রতি মাসে একটি সামান্য অঙ্কের টাকা দলের প্রধানের কাছে জমা করেন। স্ব-সহায়ক দল গ্রামের মহিলাদের কাছে অনেকটা ব্যাঙ্কের ন্যায় কাজ করে। 

ত্রয়ীর অন্যতম উদ্যোক্তা লীলাবতীর নিজস্ব একটি স্ব - সহায়ক দল আছে, ধোবাখুড়িয়া মহিলা স্ব -সহায়ক দল। তাঁর দলে এখন ১০ জন মহিলা রয়েছেন। এরা বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যেমন - সেলাই মেশিনের মাধ্যমে জামাকাপড় বানানো, এব্রয়ডারি গয়না তৈরি, অভিনব উপায়ে চাষবাস করা ইত্যাদি। এছাড়া পারিবারিকভাবেও মহিলারা অন্যান্য ব্যবসা করে থাকেন। যেমন শালপাতার সামগ্রী বানানো থেকে শুরু করে বাবুই ঘাসের ঘর সাজানোর জিনিস। লীলাবতী, সুরঞ্জনা এবং কাকলী ঠিক করেন গ্রামাঞ্চলের এই জাতীয় কারিগরিকে একছাদের তলায় নিয়ে আসবেন। এই চিন্তাভাবনা থেকেই ত্রয়ীর উৎপত্তি।  

আধুনিকতার ছোঁয়ায় পৃথিবী মুড়ে যাচ্ছে প্লাস্টিকে। শেষ কবে কোলকাতা এবং সংলগ্ন অঞ্চলে শালপাতার থালায় অনুষ্ঠান বাড়িতে পরিবেশন হয়েছিল তা খুঁজে বের করা দায়। অথচ এক সময় কেবল শালপাতার থালা এবং বাটিতেই খাবার পরিবেশন করা হত। লীলাবতীরা চাইছেন আবার এই প্রথা ফিরিয়ে আনতে। শালপাতার থালা পুরোটাই পরিবেশ বান্ধব। এতে দূষণের কোনও সম্ভাবনা নেই। আর কাঁচা শালপাতা কুড়িয়ে, রোদে শুকিয়ে থালা বানালে গ্রামে বাড়তি কিছু কর্মসংস্থানও হবে। এই বিষয়টি খেয়াল রেখেই ত্রয়ী শালপাতার থালা বানাতে শুরু করে। ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া অঞ্চলের আদিবাসীদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আজও শালপাতা ব্যবহার করা হয়। এই মুহুর্তে ত্রয়ীতে কেবল শালপাতার থালাই বানানো হচ্ছে। আগামী সময়ে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে শালপাতা দিয়ে অন্য জিনিসও তৈরি করবেন। 

শালপাতার ব্যবসা করা যায় বছরের প্রায় আট মাস। এই থালা তৈরি করেই অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হচ্ছে গ্রামীণ পরিবারগুলি। তাদের বার্ষিক আয় বেড়েছে প্রায় ২৪ হাজার ১০০ টাকা যা পূর্বের থেকে ৯৬.৪% বেশি। 

ভোলজার ( বিশ্ব ব্যবসায়িক গবেষণা সংস্থা) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ - ২৩ সালে ভারত গোটা পৃথিবীর মধ্যে শালপাতার থালা রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে ছিল। এই অর্থনৈতিক বছরে ৩৮ হাজার ১৫৫ বার প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে শালপাতার থালা রপ্তানি করেছে ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ইজরায়েল এই থালা আমদানিকারীদের অন্যতম। বিশ্ববাজারে ২০২৪ সালে শালপাতার  ব্যাবসা হয়েছে প্রায় ১১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গবেষণা অনুযায়ী অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩১ সাল নাগাদ এই অঙ্ক পৌছতে পারে ২৫.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে।  

শালপাতার জিনিস বানানোর পাশাপাশি, ত্রয়ী দেশজ ধানের চাষও করে থাকে। ভারতীয় দেশজ ধানের চাষের একটা ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬০ – ১৯৭০ এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ১ লক্ষ ধানের প্রজাতি পাওয়া যেত। কিন্তু আস্তে আস্তে এই প্রজাতিগুলি বিপন্ন হতে শুরু করে। কিছু কিছু ধানের প্রজাতির মধ্যে বিভিন্ন জিনগত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। প্রযুক্তি উন্নত না থাকায় জিনগত রোগ থেকে ধানের প্রজাতিগুলিকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। মূলত বেশি উৎপাদনের আশায় কৃষকরা ধীরে ধীরে দেশজ ধানের চাষ ছেড়ে হাইব্রিড চাষ করতে শুরু করেন। সঙ্গে শুরু হয় প্রচুর রাসায়নিকের ব্যবহার ও ভুগর্ভস্থ জলের অনিয়ন্ত্রিত প্রয়োগ। 

ত্রয়ীর উদ্যোগে বেলপাহাড়িতে দেশজ ধানের চাষ শুরু হয়েছে। ত্রয়ীর মহিলারাই ব্রাউন রাইস, ব্ল্যাক রাইস, বাদশাভোগ চাল চাষ করছেন। এর মধ্যে অনেকে আবার ব্রাউন রাইসের চিঁড়ে বানাতেও শুরু করেছেন। সুরঞ্জনা মাহাতো ঠিক করেছেন ত্রয়ীতে কেবল আতপ চাল দিয়েই ব্যাবসা করা হবে। অনেকের ভ্রান্ত ধারণা আতপ চাল এবং সেদ্ধ চাল দুটি আলাদা আলাদা চালের ধরণ। তবে এগুলি চালের কোনও প্রকার নয় বরং ধান থেকে চাল উৎপাদনের পদ্ধতি মাত্র। মাঠ থেকে ধান তুলে রোদে শুকিয়ে যখন চাল বের করা হয়, সেই চালকে বলা হয় আতপ চাল। আবার সেদ্ধ চালের ক্ষেত্রে সেই একই ধানকে প্রথমে গরম জলে হালকা ভাপিয়ে নেওয়া হয়। এরপর হালকা শুকিয়ে নেওয়া হয়। পরে আবার ওই ধানকে ৩৬ থেকে ৩৮ ঘন্টার জন্য ঠাণ্ডা জলে ভিজিয়ে রাখা হয় যাতে ৩০ - ৩৫ % আর্দ্রতা থাকে। এরপরে এই হালকা ভিজে ধানগুলিকে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। ধান শুকিয়ে গেলে মেশিনের সাহায্যে চাল বের করে নেওয়া হয়। এইভাবেই সেদ্ধ চাল তৈরি হয়। 

সেদ্ধ চালের মধ্যে ২০-২৫% এমাইলোজ থাকে। চালে এমাইলোজের উপস্থিতি কার্বোহাইড্রেট দহনে দেরি করে। কার্বোহাইড্রেট দহনের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় গ্লাইসেমিক সূচক। সেদ্ধচালের গ্লাইসেমিক সূচক আতপ চালের চেয়ে অনেকটাই কম। সাধারনভাবে সেদ্ধ চালের গ্লাইসেমিক সূচক ৩৮ এবং আতপ চালের ৮৯। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্যে সেদ্ধ চাল উপযুক্ত হলেও সাধারণ সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে আতপ চাল বেশি উপযোগী। সেদ্ধ চালে প্রোটিন,ফ্যাট, ভিটামিন এবং খনিজ লবন চালের  তুষে লেগে থাকে। ধান থেকে তুষ ছাটাই প্রক্রিয়ায় চাল উৎপাদনের সময় এ সব উপাদানের প্রায় সবটাই নিষ্কাসিত হয়ে যায়, কেবল অবশিষ্ট থাকে শর্করা। যারা ডায়েট করছেন বা দেহে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ কমাতে চান তাদের ক্ষেত্রে সেদ্ধ চাল খাওয়া একেবারেই উচিত নয় বলে মনে করেন পুষ্টিবিদরা। 

আতপ চালের পুষ্টিগুণ সেদ্ধ চালের থেকে অনেকটাই বেশি। প্রথমত আতপ চাল জলে সেদ্ধ করা হয়না, উপরন্তু ঠাণ্ডা জলে ধান ভিজিয়ে রাখার ফলে চালের পুষ্টিগুণ অটুট থাকে। আতপ চাল মেশিনে পালিশ করার বদলে ঢেঁকিতে ভাঙ্গা হয়। ফলে চালের গা অমসৃণ থাকলেও সমস্ত পুষ্টিগুণ বজায় থাকে। 

সুরঞ্জনা গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে নিয়েই নানা ধরণের দেশজ ধানের চাষ করছেন। পাশাপাশি বানাচ্ছেন দেশজ ধানের চিঁড়ে। এই চিঁড়ে তৈরির পদ্ধতি পদাতিককে জানিয়েছেন সুরঞ্জনা। প্রথমে, ব্রাউন রাইসের ধান কেটে ঝাড়াই-মাড়াই করে রোদে শুকিয়ে ধানের আর্দ্রতা ১০–১২ শতাংশের মধ্যে নিয়ে আসতে হয়। এরপর শুকনো ধান কুলোয় ঝেড়ে অথবা ব্লোয়ার চালিয়ে ধুলো মুক্ত করা হয়। শুকনো ধান ঠান্ডা জলে ২৫–৩০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। তবে ধান ভেজানোর আগে জল উষ্ণ উষ্ণ গরম করে নিতে পারলে চিঁড়ে দীর্ঘ দিন মজুত করা সহজ হয়। ধান ভেজার পর ধান তুলে জল ঝরিয়ে ফেলা হয়।

এর পর ভিজে ধান ঢেঁকিতে ফেলে পাটাই হয়। বর্তমানে চিঁড়ে তৈরির কল বেরিয়েছে। চিঁড়েকলে রোলারের চাপে ধান চ্যাপ্টা হয়ে যায়। ধানের খোসাও রোলার ঢেঁকির চাপে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চাল থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসে। ঢেঁকিতে অথবা চিঁড়েকলে ধান দেওয়ার আগে বালিতে অল্পক্ষণ ভেজে নিয়ে চিঁড়ের গুণমান বাড়ানো হয়। 

অতঃপর ঢেকির খোল অথবা চিঁড়েকল থেকে খোসামিশ্রিত চিঁড়ে বের করে নেওয়া হয়। তারের জালের বড়ো চালুনিতে ফেলে ভালোভাবে চালা হয়। ফলে গুঁড়োগুলি চালুনির তলায় পড়ে যায়। চালুনির উপরে চিঁড়ে আলাদা হয়ে জমা হয়। 

বেলপাহাড়ি থেকেই ত্রয়ীর চাল এবং চিঁড়ের ব্যাবসাকে ভারতের বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে দিতে চাইছেন সুরঞ্জনা। তাঁর লক্ষ্য এই দেশজ চাল দিয়েই চটজলদি “ওয়ান বোল মিল” (One - bowl meal)। যেমন - ব্ল্যাক রাইসের পায়েস, ব্রাউন রাইসের নোনতা পোহা, আতপ চালের খিচুড়ি ইত্যাদি। সুরঞ্জনা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে মানুষের কাছে সময় খুবই অল্প, সেক্ষেত্রে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন চালের খাবার বাজারজাত করতে পারলে চাহিদা বাড়তে পারে। সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী বাড়বে মুনাফা। 

আচার শুধু মাত্র মুখরোচক খাবার নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের নানান স্মৃতি। ছোট বেলায় আচার চুরি করে ধরা পড়ার অভিজ্ঞতা সকলেরই কমবেশি আছে। বাঙালি বড়িতে আজও দুপুরে ভাত খাবার পরে আচারের কদর একই রয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আচার খাওয়ার ধরণ একেক রকম। বিভিন্ন সিজনের ফল দিয়ে তৈরি করা হয় টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের হরেক রকম আচার। এসব আচার আমাদের মা দিদিমায়েরা নিজের হাতে যত্ন সহকারে তৈরি করতেন। সময়ের অভাবে এখন এই সকল আচারের স্বাদ থেকে আমরা প্রায়শই বঞ্চিত হই। তবে এই শুণ্যতা পূরণেই এগিয়ে এসেছে ত্রয়ী। ত্রয়ীর আচার একেবারেই বাড়িতে বানানো। এই আচারের অনন্যতাই হল ট্রাডিশানাল স্বাদ।  

ত্রয়ীতে বিভিন্ন দেশীয় আচার পাওয়া যায়। এর মধ্যে জলপাইয়ের টক-ঝাল-মিষ্টি আচার, কুলের আচার, রসুনের আচার, তেঁতুলের আচার অন্যতম। কাকলির তত্ত্বাবধানে ত্রয়ীর মহিলারা ১০০ শতাংশ প্রাকৃতিক জিনিস দিয়েই বাড়িতে বানান এই সমস্ত আচার। 

আচার তৈরি করার সময় তাতে তেল বা ভিনেগার মেশানো হয়। ফল বা সবজির আচার তৈরির ক্ষেত্রে তেল বা ভিনেগারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ল্যাকটিক, সাইট্রিক ও অ্যাসেটিক তৈরি করে। এই তিন অ্যাসিডই শরীরের পক্ষে ভালো। এই উপাদানগুলো শরীরের মধ্যে উপকারী মাইক্রোবসদের আরও সক্রিয় ও শক্তিশালী করে তুলতে সাহায্য করে। আমাদের অন্ত্রে কাজ করে এই মাইক্রোবস। যে কারণে  আচার খেলে বাড়ে হজমশক্তি, ভালো হয় মেটাবলিজম। সেইসঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণে থাকে কোলেস্টেরলের মাত্রাও। 

আচারে তেল বা ভিনেগার ছাড়াও দেওয়া হয় নানা রকমের মশলা। নুন,লঙ্কা, হলুদ ও অন্যান্য মশলা ব্যবহার করার কারণে আচারে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যুক্ত হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত আচার খেলে ইমিউনো সিস্টেম বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায় অনেকটাই। আচারে ভিটামিন এ, সি, কে এবং ফোলেট থাকে। এছাড়াও খনিজ মৌলের মধ্যে ক্যালসিয়াম, আয়রন এবং পটাসিয়ামের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। নিয়মিত আমলকী এবং আমলকি দিয়ে তৈরি আচার খেলে আলসার কমে। আলসার বলতে টিস্যুতে অ্যাসিডের মিথস্ক্রিয়া এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লির হঠাৎ ব্যর্থতার কারণে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ ক্ষতকে বোঝায়। এটি মূলত গ্যাস্ট্রিক আলসার যা হাইপার অ্যাসিডিটির ব্যর্থতা এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লির ব্যর্থতার কারণে হয়। নিয়মিতভাবে আমলকী এবং আমলকির আচার খেলে আলসারের সম্ভাবনা কমানো যায়। 

হলুদ, সেই প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে এই মশলাটির গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু যে রান্নায় হলুদ ব্যবহার করা হয় তাই নয়, সুন্দর ত্বক পেতে হলুদবাটা মাখারও চল রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রোজ সকালে যদি এক টুকরো কাঁচা হলুদ খাওয়া যায় তাহলে নানা শরীরিক উপকার পাওয়া যায়। শরীর সুস্থ রাখতে এক কুঁচি কাঁচা হলুদের কোনও বিকল্প হয় না। কাঁচা হলুদে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-৬, পটাশিয়াম, ফাইবার, ম্যাগনেশিয়াম, ও ভিটামিন সি থাকে। এতে কার্কিউমিন এবং আরও অনেক অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান থাকে। তাই, কাঁচা হলুদ খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, ত্বকের যত্নে সাহায্য করে সকালে খালি পেটে খেলে রক্ত পরিষ্কার থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, রোজ ২৫০ মিলিগ্রাম হলুদ খাওয়াই যথেষ্ট। সকালে ও রাতে দুই বেলায় ২৫০ মিলিগ্রাম করে হলুদ খাওয়া যেতে পারে। সকালে খালি পেটে হলুদ খাওয়ার পর আধ ঘণ্টা কিছু না খাওয়াই উচিত। আবার রাতে ঘুমোনোর আগে হলুদ-দুধ খাওয়া যেতে পারে। 

তবে বাজারে এখন নানা রকমের ভেজাল হলুদের ভিড়। হলুদের নিজস্ব গন্ধ একেবারে থাকে না বললেই চলে। আর প্যাকেট করা হুলুদ গুঁড়োয় রঙের জন্যে মেশানো হয় নানা রকমের কেমিকেল ডাস্ট। ফলে হলুদের আসল গুণাগুণ তলানিতে এসে ঠেকছে। 

বাজারে প্রকৃত হলুদ গুঁড়ো পৌঁছে দিতে ত্রয়ী বর্তমানে শুরু করেছে কাঁচা হলুদ এবং হলুদ গুঁড়োর ব্যাবসা। বেলপাহাড়ির মহিলারা প্রাথমিকভাবে খুব ছোট পরিসরে হলুদ চাষ করতেন, কখনো বাড়ির উঠোনে বা কখনো জঙ্গলের একটা কোণায়। সেই সময় চাষের হলুদ রোদে শুকিয়ে নিজেরাই বাড়ির কাজে ব্যাবহার করে ফেলতেন। পরে তারা ঠিক করেন এই জৈবিক উপায়ে উৎপাদিত হলুদ নিয়ে ব্যাবসা করবেন। 

স্ব-সহায়ক দল থেকে গ্রামের মহিলারা হলুদ গুঁড়ো তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে তারা ত্রয়ীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছেন। এখনও পর্যন্ত ঝাড়গ্রামের মধ্যেই তারা এই ভেজাল বিহীন হলুদ গুঁড়োর ব্যাবসা চালাচ্ছেন। ত্রয়ী চাইছে দেশের অন্যান্য শহর এবং রাজ্যেও তাদের উৎপাদিত সামগ্রীগুলি পৌঁছে দিতে। 

গ্রামের দিকে বেড়াতে গেলে আমরা প্রায়শই একধরণের সরু লম্বা জাতীয় ঘাস দেখতে পাই। গ্রামের মহিলারা সেই ঘাস বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছেন এই দৃশ্যও কমবেশি সকলের চেনা। এই ঘাসটির নাম বাবুই। এটিকে সাবাই ঘাসও বলে থাকেন অনেকে। এই ঘাসের নানাবিধ বৈশিষ্ট রয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল এর পরিবেশ বান্ধবতা। শিল্পীরা চলতি ফ্যাশানের সঙ্গে ট্রাডিশনকে মিলিয়ে বাবুই ঘাসের নানা জিনিস বানাচ্ছেন।  

ত্রয়ীর শিল্পীরা বাবুই ঘাস দিয়ে ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করছেন। এরমধ্যে ফুলদানি,ধূপদানি, লক্ষ্মীর ঝাঁপি, গয়নার বাক্স,ঝুড়ি, প্লেট, বাটি নজর কেড়েছে পর্যটকদের। বাবুই শিল্পীদের পুঁজি খুব সামান্য। স্থানীয় বাজারে এই শিল্পের বিশেষ চাহিদাও নেই। অনুরূপভাবে, বিভিন্ন মেলায় আবার বাবুই ঘাসের জিনিসের চাহিদা অনেক বেশি। তবে, মেলা থেকে উপযুক্ত রোজগার হয়না শিল্পীদের। ফলে অধিকাংশ বাবুই শিল্পীদের দরিদ্র সীমার নীচেই বাস করতে হচ্ছে। ত্রয়ীর মারফত শিল্পীরা বাইরের শহরের সঙ্গে সাপ্লাই চেন তৈরি করতে চাইছেন। এরফলে স্থানীয় শিল্প বিশ্ব দরবারে পৌছনোর যথেষ্ট সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। 

ত্রয়ী বেলপাহাড়ির কারিগরদের স্বপ্নপূরণের ঠিকানা। এই সংস্থা সাধারণের জীবন জীবিকায়  সাহায্য করার পাশাপাশি বাংলার বিভিন্ন শিল্পকে সংরক্ষণ করছে। শালপাতার থালা, বাবুই ঘাসের ঘরসজ্জা, অর্গ্যানিক হলুদ, দেশজ ধান এইসকল যে কেবলমাত্র সুস্থায়ী জীবনধারাকেই উৎসাহিত করছে তাই নয়! সঙ্গে গ্রামীণ নিম্ন - মধ্যবিত্ত পরিবারগুলিতেও অর্থসংস্থানের ব্যাবস্থা হচ্ছে। লীলাবতী মনে করেন ত্রয়ীকে সমর্থন করা মানে পরিবেশ রক্ষার জন্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ত্রয়ী আদতেই শিল্প, সংস্কৃতি এবং পরিবেশ রক্ষার অসাধারণ মেলবন্ধন।  

 ভাবার মতো প্রশ্ন - 

  • অন্যান্য আর্থ- সামাজিক সংস্থার সঙ্গে ত্রয়ীর মডেলের গঠনগত এবং কার্যগত ঠিক কি কি তফাত আছে? 
  • বিগত পাঁচ বছরে বেলপাহাড়ি এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের আয় এবং বর্তমানে ত্রয়ীর উপস্থিতিতে সেই পরিবারগুলির আয় ঠিক কত শতাংশ বেড়েছে? যদি আশানরূপ ফল না হয় তাহলে ঠিক কি কি বাঁধা রয়েছে? 
  • শালপাতা ও বাবুই ঘাসের জিনিস দীর্ঘদিন ব্যাবহার করলে কি কি ধরণের উপকারিতা পাওয়া যেতে পারে? 
  • ত্রয়ী বিশ্ববাজারে ব্যাবসা করতে গেলে কোন কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে?

Reference -

researchgate.net

 verifiedmarketresearch.com

 researchgate.net

Sabai Grass: Empowering Artistry, Sustainability, and Craftsmanship 

আরো উদ্যোগের খবর

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram