বাদ্যযন্ত্রের পারিবারিক ব্যবসায় নতুন দিগন্ত আনছে সুমনার কানহা’জ  

Saheli Mazumdar
January 14, 2025

বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজে তাঁর পূর্বপুরুষ গিয়েছিলেন বেনারসে। নানা গুণী মানুষদের সান্নিধ্যে থেকে যান সেখানেই। বাদ্যযন্ত্র বানানোর পাশাপাশি বাজনা শিখতে শুরু করেন। যদিও কিছু সময় পর তারা ফিরে আসেন বাংলায়। আশি বছর যাবৎ চলছে পারিবারিক এই ব্যবসা।  নিজের বাজনার দোকান কানহা’জ মিউজিকে বসে অমলীন হাসি নিয়ে একথাই বললেন সুমনা ভট্টাচার্য। 

সুমনার বয়স এখন তিরিশ। ছোট থেকেই গান বাজনার মাঝেই বেড়ে ওঠা তাঁর। মাত্র ছমাস বয়সে মাতৃহারা হন। বাবাকেও হারান চার বছর বয়সে। এরপর ঠাকুরদা, ঠাকুরমা এবং কাকা তাঁকে বড় করেন। 

সুমনা একজন সেতার বাদক। চার বছর বয়সে সেতারে হাতেখড়ি হয়। দীর্ঘ ২৬ বছর তিনি সেতার বাজাচ্ছেন। সেতার কীভাবে বানাতে হয় সুমনা সেটাও জানেন। বাদ্যযন্ত্র বানানোর শিক্ষা পেয়েছেন তাঁর ঠাকুরদা শ্রীরামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ও কাকার থেকে। এর পেছনে  ভট্টাচার্য বাড়ির একটা ছোট্ট ইতিহাস রয়েছে।

সুমনার ঠাকুরদার শ্বশুরমশাই অর্থাৎ প্রিয়রঞ্জন ব্যানার্জী ছিলেন সেই সময়ের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব। বিয়ের পরে ১৯৪২ সাল নাগাদ তিনি সুমনার ঠাকুরদা এবং ঠাকুর মাকে নিয়ে বেনারস চলে যান।  শ্বশুর মশাইয়ের কাছ থেকে বাদ্যযন্ত্র কিভাবে বানাতে হয় সেই শিক্ষা নিতে শুরু করেন শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বেনারসে থাকাকালীন দেশ-বিদেশের গুণী ব্যক্তিদের সান্নিধ্যে আসেন। আস্তে আস্তে শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য সেই সময়ের অন্যতম বাদ্যযন্ত্র কারিগর হয়ে ওঠেন। তবে মাত্র পাঁচ বছর পরেই তারা ফিরে আসেন কলকাতায়। ফিরে এসে বাড়িতেই শুরু হয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ। দেশ বিদেশ থেকে নিত্য নতুন অর্ডার আসতে শুরু করে। ব্যবসা আস্তে আস্তে বড় হয়। 

সুমনার ঠাকুরদা বাদ্যযন্ত্রের নামকরা কারিগর হলেও তার বাবা বাদ্যযন্ত্র বানানোয় বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। তবে কাকা খুব আগ্রহী ছিলেন। সুমনার ঠাকুরদা মারা যান ২০০৩ সালে। এরপর সুমনার কাকা একা হাতে ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। সুমনা বড় হওয়ার পর তিনিও যোগ দিয়েছেন পারিবারিক এই ব্যবসায়। 

দুই বছর আগে সুমনা আলাদা করে একটা দোকান ভাড়া নিয়েছেন ব্যবসাটি আর বড় করার জন্যে। দোকানটির নাম কানহা’জ মিউজিক। এখানে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্র পাওয়া যায়। হারমোনিয়াম থেকে শুরু করে সেতার, আবার বাঁশি থেকে শুরু করে উকুলেলে। সঙ্গে রয়েছে তবলা, নানা রকমের গিটার, সরদ ইত্যাদি। এই দোকানটা এখন একা চালানম সুমনা। পারিবারিক ব্যবসা দোকান ভাড়া নিয়ে করায় বেশ আপত্তি শুনতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু এই যুগে বাড়ি থেকে ব্যবসা করে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে করেননি এই সেতার বাদক। 

সেতার ভারতের অত্যন্ত পুরনো একটি বাদ্যযন্ত্র। সেতারের আবিষ্কর্তা সম্বন্ধে নানা রকমের মতভেদ রয়েছে। কিছু কিছু গবেষণা থেকে জানা যায় চতুর্দশ শতাব্দীতে সংগীতবিদ আমির খসরু ‘সহতার’ নামে তিনটি তার বিশিষ্ট একটি নতুন যন্ত্র আবিষ্কার করেন।  যা পরে সেতার হিসেবে প্রচলিত হয়। ফরাসি ভাষায় ‘সহ’ বা ‘সেহ’ মানে তিন। 

অন্য গবেষণায় বলা হয়, ভারতীয় তন্ত্রবাদ্যের অন্তর্ভুক্ত ত্রিতন্ত্রী বা কচ্ছপি নামক বীণাকেই সামান্য পরিবর্তন করে খুসরু নাম দিয়েছিলেন সহতার। গবেষণা থেকে আরো জানা যায়, আমির খসরু এই যন্ত্রটি তৈরি করেছিলেন তার পুত্রের জন্য। আমির খসরুর পুত্র ফিরোজ খাঁর কন্ঠ গান গাওয়ার উপযুক্ত ছিল না।  সেই কারণে খুশরু নতুন এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেন। অন্য গবেষণায় বলা হয়, সেতারের উৎপত্তি হয়েছে গ্রীস এবং আরবের কিছু বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণে। 

খুসরু সাহেবের সেতারে ছিল তিনটি তার। পরে এই বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়। ১৭০৭ থেকে ১৭১৯ সালের মধ্যেই বাদশাহ মহম্মদ শাহ বীণার তিনটি তার সেতারে যোগ করেন। পরে ৭টি এবং ৮টি তারের সেতারের প্রচলন হয়। যদিও সাতটি তারের সেতার বহুল পরিচিতি পায়। 

যুগের সঙ্গে সেতারের নানা বিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে সেতার ১.২ মিটার বা চার ফুট উচ্চতার হয়। সেতারের নিম্নভাগের বড় গোলাকার অংশটিকে বলা হয় তুম্বা। এটি আসলে বৃহদাকার লাউয়ের একটি খোলস। তুম্বার ওপরে কাঠের তৈরি লম্বা অংশটি হল তবলি। তবলি সাধারণত সেগুন বা তুন কাঠের হয়ে থাকে। এখন সর্বোচ্চ ২১ টি তারের সেতার দেখা যায়। তবে ১৮, ১৯,২০ এই সম্বনয়ের সেতারও পাওয়া যায়। এই তারগুলির মধ্যে তিনটি তার থাকে বাজানোর জন্যে। এই তারগুলির সুর বাঁধা থাকে মা সা পা স্বরে। চতুর্থ তারটি হল বেইজ তার। এই তারে সা সুর বাঁধা হয়। এছাড়াও থাকে তিনটি সংগতকারী তার। এগুলিকে চিকারির তার বলা হয়। এগুলো সা সা গা-তে বাঁধা হয়। ৯ থেকে ১৩টি তার থাকে সুরের কম্পন ধরে রাখার জন্য। এগুলিকে তরফের তার বলা হয়। সব শ্রেণির তারই তুম্বার উপরিস্থিত বায়ার এক প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে ডান্ডির উপরিভাগে গিয়ে শেষ হয়। অনেকটা চাবির মতো দেখতে কুন্তি দিয়ে এই তারগুলিকে আটকে রাখা হয়। 

সেতারের দুটি প্রকারভেদ রয়েছে। প্রকার অনুযায়ী সেতারের ঘরানা ভিন্ন। খরজ পঞ্চম সেতারে তিন এবং চার নম্বর তারটি তুলনামূলক মোটা হয়। তার দুটি ব্রোঞ্জ দিয়ে বানানো হয়। খরজ পঞ্চম সেতার মূলত ওস্তাদ রবিশঙ্করের ঘরানার প্রতীক। গান্ধার পঞ্চম সেতার আবার ইমদাদখানি ঘরানায় ব্যবহার হয়।   

সেতার নির্মাণ বেশ কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ। একটি সেতার বানাতে কমপক্ষে দুমাস সময় লাগে। দীর্ঘ অধ্যাবসায় প্রয়োজন নিখুঁত সেতার বানানোর জন্যে। সুমনার কাকা দীর্ঘ দশ বছর পরিশ্রম করে সেতার বানানো শিখেছিলেন। ছেলেকে হাতে ধরে সেতার নির্মাণ শিখিয়েছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ছোট থেকেই সুমনা বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র বানাতে দেখে বড় হয়েছেন। 

সুমনা বাদ্যযন্ত্র বানাতে পারলেও দোকানের সমস্ত অর্ডার কারিগর দিয়েই বানান। সেতার বাজাতে মিজরাফ নামের একটি ছোট যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। মিজরাফের তার ভীষণ শক্ত। এটি বানাতে অনেকসময় কারিগরদের হাতে চোট পান। সেইসময় প্রায় ছমাস কাজ বন্ধ রাখতে হয়।  

মিজরাফ বানানো বেশ কঠিন। শিল্পীর আঙ্গুলের মাপের মিজরাফ না হলে অনেক ধরণের সমস্যা হয়। একজন সেতার বাদকই জানেন মিজরাফের আসল গুরুত্ব। 

সুমনার কাকা এই দোকানটি শুরু করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন নিজেদের বাড়ির গন্ডির মধ্যেই ব্যবসাটি সীমাবদ্ধ রাখতে। বাড়ি থেকে ব্যবসা করলে বাদ্যযন্ত্রের দাম কিছুটা হলেও কম হয়। দোকান থেকে বিক্রি করলে বাড়তি কিছু খরচও তার সঙ্গে জুড়ে দিতে হয়। সেক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্রটার মোট দামে কিছু হেরফের হয়। 

সুমনার এই দোকানটা শুরু করার পিছনে একটা বড় কারণ বাজারে নির্ভরযোগ্য বাদ্যযন্ত্রের অভাব। সুমনার এক ছাত্রী দেড় লক্ষ টাকা দিয়ে নামকরা দোকান থেকে সেতার কেনেন। তিনমাস ব্যবহার করার পর সেই সেতারটি ফেলে দিতে হয়। এই ঘটনার পর থেকেই তিনি ঠিক করেন বাদ্যযন্ত্রের একটি দোকান করবেন। এখনও পর্যন্ত কলকাতা শহরে কোনো সেতার বাদকের বাদ্যযন্ত্রের দোকান নেই। সুমনা ভট্টাচার্যই প্রথম যিনি একটি আস্ত বাদ্যযন্ত্রের দোকান তৈরি করেছেন। 

কানহাজ মিউজিকের জন্যে বহু কারিগর কাজ করেন। বর্তমানে সুমনা তাদের ঠিকায় বাদ্যযন্ত্র বানানোর অর্ডার দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে কাজ আরও তাড়াতাড়ি হয়। 

বাদ্যযন্ত্র কেনার উত্তম সময় শীতকাল। তাই শীতকালেই কানহাজ মিউজিকে বিক্রির হারও বেড়ে যায় অনেকটা। এই সময়ে মাসে প্রায় তিন থেকে চার লক্ষ টাকার বিক্রি হয়। শিল্পী হিসেবে সুমনার বিশেষ পরিচিতি থাকায় তার ব্যবসা সহজে বেড়ে উঠছে। 

বাদ্যযন্ত্র বিক্রির পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্র মেরামতি করা হয় এখানে। পাশাপাশি বিক্রি হয় বাদ্যযন্ত্রের কিছু খুচরো যন্ত্রপাতিও। এই মূহুর্তে সুমনা বিদেশের মাটিতে ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করায় ঝোঁক দিয়েছেন। তার ব্যাক্তিগত পরিচয় এক্ষেত্রে তাঁকে বাড়তি সাহায্য করছে তা বলাই বাহুল্য। নিজের পারিবারিক ব্যবসাকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সুমনা। 

ভাবার মতো প্রশ্ন -  

  • সেতার কীভাবে তার ফার্সি উৎস থেকে বিবর্তিত হয়ে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে? 
  • কারুকার্য এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক উপাদান কিভাবে সেতারের বিবর্তনকে প্রভাবিত করে?
  • কীভাবে উপাদান বিজ্ঞানের (material science) অগ্রগতির সঙ্গে সেতারের বিভিন্ন অংশ পরিবর্তিত হতে পারে? এতে কি সেতারের আওয়াজের কোনও পরিবরতন হবে? 

Reference - 

UNIQUENESS OF SITAR AS A MUSICAL INSTRUMENT

(PDF) The physical modelling of a sitar

(PDF) Stylistic Evolution of Sitar baaj in 20th and 21st Century

HISTORY OF SITAR

Sitar Instrument Overview

আরো উদ্যোগের খবর

linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram