৪০ একর অনুর্বর জমিতে গাছ লাগিয়ে বনাঞ্চল বানিয়েছেন নরেন হাঁসদা। এই কাজ তিনি একা করেননি। সাহায্য করেছে তার সংস্থার খুদে সদস্যরাও।
২০২১ সালের ইন্ডিয়া স্টেট অফ ফরেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ৭ লক্ষ ১৩ হাজার ৭৮৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা বনভূমি আবৃত। যা ভারতের মূল ভূখন্ডের মাত্র ২১.৭১ %। ১৯৯০ সালে ভারতে বনভূমির পরিমাণ ছিল ৬ লক্ষ ৪০ হাজার ৮১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ৭৪২.২ বর্গকিলোমিটার করে বনভূমি হ্রাস পেতে থাকে। ২০১৬ সালে ভারতের ১ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর বনভূমি কাটা পড়ে। ২০১৭ সালে এই পরিসংখ্যান বেড়ে দাঁড়ায়, ১ লক্ষ ৮৯ হাজার হেক্টরে। ২০২৩ সালে এই পরিসংখ্যান খানিকটা কমে ১ লাখ ৪৪ হাজার হেক্টরে পৌঁছয়।
নরেন হাঁসদা সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন গায়ক। পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় তাঁর বাস। খুব ছোট বয়সেই পড়াশুনোর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয় নরেনের।সেই সময় থেকেই আঁকড়ে ধরেন গানকে। ছাড়েন নিজের গ্রাম জাহাজপুর। গানের শিক্ষক হিসেবে বেছে নেন রেডিও শিল্পী লসারাম তুতুকে।
গান শেখার সঙ্গে বিভিন্ন গ্রামে অনুষ্ঠান করতেও শুরু করেন নরেন। বাড়তে থাকে পরিচিতি। পুরুলিয়ার গন্ডি পেড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলায় শুরু করেন অনুষ্ঠান। ডাক আসে বহিঃরাজ্য থেকেও।
এই সময়ে ভালিডুংরি গ্রামে থাকতেন নরেন। ২০১৫ সালে বড়ুয়াকোচা গ্রামে অনুষ্ঠান করতে যান তিনি। অনুষ্ঠান শেষে গ্রামবাসীরা নরেনের কাছে অদ্ভুত একটি আবদার করেন। গ্রামের ৪ জন অনাথ শিশুকে দত্তক নেওয়ার আর্জি জানান।
অনাথ বা পিছিয়ে পড়া শিশুদের সাহায্য করতে নরেন হাঁসদা শুরু করেন একটি এনজিও। নাম দেন “সিধু কানু মিশন ফাউন্ডেসন”। বর্তমান সময়ে ৩০ জনেরও বেশি অনাথ শিশু এই সংস্থায় রয়েছে। ৪০০ জনেরও বেশি পিছিয়ে পড়া শিশুরা “সিধু কানু মিশন স্কুলে” পড়াশুনো করছে।প্রথমে সাতজন শিক্ষক এই বিদ্যালয়ে পড়াতে শুরু করেন। বাংলা এবং সাঁওতালী ভাষায় পড়ানো হয় এই বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়টির বিভিন্ন শাখা নয়াগড়, ঝালদা, বড়ুয়াকোচা,হারাদা এবং ছারাতে অবস্থিত। কিছু ছাত্রের অভিভাবক মাইনে বাবদ মাসে ৫০ টাকা দেন। আবার অনেকে বিনা পয়সাতেই পড়ে এই স্কুলে। স্কুলে কেবল পড়ানো হয়না। দেওয়া হয় খাবার, বই, খাতা এবং পড়াশুনোর যাবতীয় জিনিস। নরেন এই বাচ্চাদের গান এবং বিভিন্ন ধরণের বাজনার প্রশিক্ষণও দেন।
বাচ্চাদের পড়াশুনো শেখানোর পাশাপাশি নরেন হাঁসদা পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন। অযোধ্যা পাহাড়ের ৫ কিলোমিটারের মধ্যেই তাঁর গ্রাম। এলাকাটি ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। এই অঞ্চলটি অনুর্বর এবং পর্ণমোচী বনভূমি। বিভিন্ন কারণে এলাকার প্রচুর গাছ কাটা হচ্ছিল। পাহাড় থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল পাথর এবং বোল্ডার। শুষ্ক আবহাওয়ায় গাছের গুরুত্ব কতোটা তা বুঝেছিলেন নরেন। তাঁর আশঙ্কা ছিল বিশুদ্ধ পানীয় জলের মতো অক্সিজেনও হয়তো বোতলে বিক্রি করতে হবে।
আশঙ্কা থেকেই শুরু করলেন গাছ লাগানো। প্রথমে নিজের উদ্যোগেই পাহাড়ি জমিতে গাছ লাগাচ্ছিলেন। তাঁকে সাহায্য করতো পুরুলিয়া ধরতি মর্শাল সোসাইটির বাচ্চারা। ২০১২ সালে এই সংস্থা বানান নরেন হাঁসদা। নরেনের উদ্যোগে সাড়া দেয় বনদপ্তর। তারা প্রচুর গাছের চারা বিনামূল্যে দেন নরেনদের।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রাথমিকভাবে নরেন এবং ৫ জন বাচ্চা এই কাজ শুরু করে। তাদের সকলের বয়স ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। তাদের প্রতিদিনের কাজ ছিল ভোরে উঠে জল নিয়ে পাহাড়ে যাওয়া। সেখানে গাছের পরিচর্যা করা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি বেড়েছে বাচ্চাদের সংখ্যাও। বর্তমানে ১১ হাজার ২০০ এর বেশি চারাগাছ দিয়ে আবৃত পাহাড়ের এই ৪০ একর জমি। নতুনভাবে বনাঞ্চল তৈরির ফলে নানা প্রজাতির পাখি এখানে বাসা বাঁধছে। এর মধ্যে দাগি তিতছাতারে (Pin-striped Tit-Babbler), গলা ফোলা ছাতারে (Puff-throated Babbler), ছোট হুতুম পেঁচা, সিঁদুরে মৌটুসি, মেটেবুক প্রিনা, বেঙ্গল বুশ লার্ক, মেটেঘাড় চটক, বন কুককুট অন্যতম।
পুরুলিয়ার ১ লক্ষ ৮৫ হাজার ৭২৬ হেক্টর এলাকা বনভূমি আবৃত। যা সমগ্র জেলাটির ২৯.৬৯%। পুরুলিয়ার বনভূমি মূলত পর্ণমোচী বৃক্ষের অরণ্য। এর মধ্যে শাল, সেগুন, পলাশ, নিম অন্যতম। কাঠবিহীন গাছের মধ্যে হরিতকি, আমলা, বহেরা, করঞ্জ, বাঁশ, কেন্দুপাতা এই এলাকায় পাওয়া যায়। পুরুলিয়া বনবিভাগের আওতায় ৭৪ রকমের গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৯ রকমের গুল্ম, ২৩ প্রকার লতানে এবং ২৭ টি প্রজাতির বাঁশগাছ পাওয়া যায়। এই এলাকায় ১০০ রকমের ঔষধি গাছেরও খোঁজ মেলে। অশ্বগন্ধা, সাতমুলি, ভৃঙ্গরাজ এর মধ্যে অন্যতম।
দাবানল বনাঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সমস্যা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষের জন্যেও বনে আগুন লেগে যেতে পারে। যেমন, বনের শুকনো পাতা দিয়ে আগুন জ্বালানো বা প্রচন্ড শীতে তাপ পোহাতে কাঠ জ্বালানো কিংবা বন্য জন্তু জানোয়ারদের দূরে রাখতে পাথর এর বেড়া করে আগুন জ্বালিয়ে রাখা। অধিকাংশক্ষেত্রে এভাবেই বনের ভিতর আগুন লেগে যায়। ভারতের ৯৫% দাবানল মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই হয়ে থাকে। বিশাল পরিমাণ বনভূমি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। সমস্যাটি জনসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে নরেন গানের মাধ্যমে সচেতনতা বাড়াতে শুরু করেন। ব্যবহার করেন নানা রকমের শ্লোগান।
সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অসহায় মহিলারা নরেনের এনজিওতে থাকেন। স্বামীর মৃত্যু হলে বিধবা মহিলাদের আর পরিবারে রাখা হয়না। অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এঁরা সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার। কুসংস্কারের ফলে তাদের ছাড়তে হয়েছে পরিবার। কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে সচেতনতামূলক প্রচারও করছেন নরেন হাঁসদা। এই মহিলারা বাচ্চাদের দেখাশুনোর পাশাপাশি এনজিও এর অন্যান্য কাজও করে থাকেন।
নরেনের সমাজমুখী উদ্যোগকে সকলেই সাধুবাদ জানান। স্বীকৃতিস্বরূপ, নরেন ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের অনাগ্রসর শ্রেণী কল্যাণ ও আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তরের তরফে সিধু কানু স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন।
যাত্রাপথটা সহজ ছিল না নরেনের জন্যে। একাধিকবার সম্মুখীন হতে হয়েছে আর্থিক প্রতিকূলতার। নিজের সুর, আর আড়াই ফুটের সাঁওতালী বাদ্যযন্ত্রই সঙ্গ দিয়েছে নরেনকে। কখনো কখনো আর্থিক সাহায্য এসেছে। আবার কখনো আসেনি। তবু হার মানেননি নরেন হাঁসদা। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়াই এখন তার মূল লক্ষ্য। বর্তমানে সাঁওতালী গানও একপ্রকার হারিয়ে যেতে বসেছে। এই সম্প্রদায়ের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতেও কাজ করছেন নরেন হাঁসদা।
References -
Innofied's Small Contribution To the Society – A Day Out to Sido Kanhu Mission, Purulia.
Meet ‘Dada’ & His Team Of Kids, Who Are Turning 40 Acres Of Barren Land Into A Mini Forest
How a Santhali folk singer & orphans turned barren land into forest at Bengal’s Ajodhya Hills
Folk singer & orphans rejuvenate barren land - Vikalp Sangam
Naren Hansda – Pied Piper of Purulia
Harmonizing with Nature: Artists Championing Environmental Conservation through Their Work
ভাবার মত প্রশ্ন -